হিন্দু ধর্ম, ধর্ম নাকি সংস্কৃতি এ নিয়ে নানা মত, ধ্যান, ধারণা বর্তমান। ভারতীয় উপমহাদেশে অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষের নিয়মিত পালিত সংস্কৃতির নাম হিন্দু ধর্ম। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা থেকে এ বৈদিক ধর্মের উৎপত্তি বলে কোন কোন ইতিহাদবিদগণ ব্যাখ্যা করে গেছেন। তবে প্রকৃত অর্থে হিন্দু ধর্ম কি?
হিন্দু ধর্মকে বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্ম বলে মেনে থাকেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। সে কারণে তারা এই ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলেও বিশ্বাস করেন। বেদ হিন্দু ধর্মের প্রধান এবং মূল ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় এই ধর্মকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়। ধর্মীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ এ ধর্মের বিশ্বাসীরা সৃষ্টিকর্তার তুষ্টিলাভ ও নিজের আধ্যাত্মিক শান্তি লাভের জন্য সব সময় কোন না কোন আনষ্ঠানিকতার উপরই নির্ভর করেন। অন্যান্য ধর্মের তুলনায় হিন্দু ধর্মের আচারের সংখ্যা অনেক। উল্লেখযোগ্য আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রধান হলো পূজা, এছাড়াও যজ্ঞ, ধ্যান, কীর্তন, ইষ্টনাম জপা, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি তো রয়েছেই।
বিভিন্ন দর্শন, সংস্কৃতি, আচার ও কলার সংমিশ্রিত জীবনধারার নাম হলো হিন্দু ধর্ম। এই ধর্মের সংস্কৃতি প্রধান চারটি উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি। ধর্ম (নৈতিকতা), অর্থ (সমৃদ্ধি), কাম (আকঙ্খা) এবং মোক্ষ (ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ) অর্জনের লক্ষ্যেই হিন্দুদের জীবন আবর্তিত। এছাড়াও সংসার বা মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্রেও বিশ্বাস রয়েছে তাদের। ধর্মীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি দয়া, ধৈর্য্য সংযম এবং জীবের প্রেমের মতো চিরন্তন জীবনাচরণকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় হিন্দুত্ববাদে। বস্তুত হিন্দু ধর্ম অহিংস হলেও কালের আবর্তে বর্তমান চালচিত্র অন্যরকম লক্ষ্য করা যায়।
হিন্দু শব্দটি প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নাম থেকে রূপান্তরিত। সিন্ধু শব্দটি ইন্দো-আর্য সংস্কৃত শব্দ। বর্তমান ভারতের উত্তর-পশ্চিমে তিব্বত থেকে বয়ে আসা নদীর নাম হলো সিন্ধু। এই উপমহাদেশের প্রাচীন সিন্ধু নদের তীরবর্তী যে জনবসতি প্রথমে গড়ে উঠেছিলো এবং তাদের সংস্কৃতিকেই সিন্ধু সভ্যতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরে জনবসতি বাড়তে থাকায় তারা ধীরে ধীরে সিন্ধু নদের দুই পাশে বিস্তৃত হতে থাকে যার পশ্চিম পাশের ভূ-খণ্ড পাকিস্তান এবং পূর্বে ভারত। তৎকালীন সময় সিন্ধুর পূর্ব তীরের বাসিন্দাদের হিন্দু বলে অভিহিত করা হতো। এবং পূর্বের ভূ-খণ্ড বর্তমানে যা ভারত তাকে হিন্দুদের বাসস্থান বা হিন্দুর ভূমি বলা হতো। পর্যায়ক্রমে তা রূপান্তরিত হতে হতে হিন্দুস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন আরব্য সাহিত্যে আল-হিন্দ বলে এই অঞ্চলের পরিচয় পাওয়া যায়।
সভ্যতার শুরুতে হিন্দু বলতে হিন্দুস্থানের সকল মানুষকে বোঝানো হতো। পরে ষোড়শ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবতের সময় যবন ও ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য হিন্দু শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে ভারতে অনুপ্রবেশকারী ইউরোপীয় বণিকদের ঔপনিবেশিক শাসকরা হিন্দুস্থানের সকলকে হিন্দু বলে আখ্যায়িত করেন। পরে শুধুমাত্র সনাতন বা পুরনো ধর্মীয় সংস্কৃতি যারা মেনে চলতো শুধু তাদেরই হিন্দু বলে মানা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এই উপমহাদেশ যখন ব্রিটিশদের দখলে তখন উপমহাদের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বুঝাতে ইংরেজরা সর্বপ্রথম হিন্দু শব্দটির সাথে ইজম যোগ করে হিন্দুইজম ব্যবহার করেন যা বর্তমানে সারাবিশ্বে পরিচিত।
হিন্দু ধর্মের অনেক শাখা, প্রশাখা। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর দর্শনের কারণে হিন্দুদের মধ্যে এত বিভাজন। তাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন দেবতারা নৈর্ব্যক্তিক যা ঈশ্বরের চূড়ান্ত রূপ আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন কোন একজন দেবতা সকল দেবতার প্রধান। দেব-দেবীরা বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়ে শুধুমাত্র প্রধান দেবতারই প্রতিনিধিত্ব করেন।
হিন্দুধর্মের ছয়টি জাতিগত ধরন বা বিশ্বাসের কারণে ছয়টি বিভাগে বিভক্ত।
- লৌকিক হিন্দুধর্ম – বিভিন্ন স্থানীয় ঐতিহ্য ও লৌকিক দেবদেবীর পূজাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক বা সম্প্রদায় স্তরের ধর্মবিশ্বাস যা প্রাগৈতিহাসিক কাল বা অন্ততপক্ষে বেদ রচিত হবার আগে থেকে প্রচলিত।
- বৈদিক হিন্দুধর্ম – এই বিশ্বাসটি এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ (বিশেষত শ্রুতিবাদী) সমাজে আজও প্রচলিত।
- বৈদান্তিক হিন্দুধর্ম – উপনিষদের শিক্ষা অবলম্বনে প্রচারিত। উদাহরণ – অদ্বৈত (স্মার্তবাদ)
- যৌগিক হিন্দুধর্ম – পতঞ্জলি রচিত যোগসূত্র অবলম্বনে প্রচারিত।
- ধার্মিক হিন্দুধর্ম বা প্রাত্যহিক নৈতিকতা – কর্ম ও হিন্দু বিবাহ সংস্কার ইত্যাদি সামাজিক নিয়মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাখা।
- ভক্তিবাদ – বৈষ্ণবধর্মের অনুরূপ ভক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ।
বস্তুত হিন্দুধর্মের কোন মূলধারা নেই। তবে শুধুমাত্র একটি কারণকেই এ ধর্মের মূল হিসেবে মানা হয়। সে কারণটি হলো একটি বিশ্বাস। সুবিস্তৃত ভৌগলিক ক্ষেত্রে এ ধর্ম বহুধাবিভক্ত। তবে সব বিভাগ এবং উপ-বিভগে বিশ্বাসের মূল উপকরণ হলো ধর্ম (নৈতিকতা/কর্তব্য), সংসার (জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের চক্র), কর্ম (ক্রিয়া ও তার প্রতিক্রিয়া), মোক্ষ (সংসার থেকে মুক্তি) ও বিভিন্ন যোগ (ধর্মানুশীলনের পন্থা)।
বহুবিভক্ত জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মধ্য দিয়েই হিন্দুধর্মের মূলধারার বিশ্বাস বিকাশলাভ করেছে এবং বর্তমানে পালিত হিন্দুদের প্রতিষ্ঠিত ধর্মবিশ্বাস রূপান্তরিত বিশ্বাসমাত্র। হিন্দুধর্মের পুরনো রীতিনীতির নবীকরণ এবং বহিরাগত রীতিনীতি ও সংস্কৃতি থেকে আত্মীকরণ করা বিচিত্র ধর্মীয় সংস্কৃতির সন্নিবেশে সজ্জিত হিন্দুধর্মের মূলধারার বিশ্বাস। বর্তমানে হিন্দুধর্মালম্বীদের ধর্মীয় বিশ্বাস মূলত অসংখ্য ছোট ছোট আদিম ধর্মমতের সমন্বয়ে গঠিত যা বৌদ্ধ, জৈন কিংবা প্রাচীন যে কোন ধর্ম থেকে তাদের আলাদা করে। প্রাচীনকালেও এ ধর্মের মানুষ থেকে অন্যান্য সাধারণ মানুষ কিংবা ধর্ম থেকে আলাদা করার জন্যই হিন্দু ধর্ম হিসেবে হিন্দু পণ্ডিত ও গুরুরা নিজেদের পরিচয় দিতেন। সহজ কথায় বলতে গেলে হিন্দুধর্ম হলো রূপান্তরিত ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সাধারণ থেকে আলাদা হওয়ার ধর্ম।