সাদা পাথর আর নীল জলের দেশ ভোলাগঞ্জ

সাদা পাথর আর নীল জলের কাব্য কথায় স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়ায় শ্বেত শুভ্র মেঘ হয়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার ছন্দে পাখনা মেলে রঙিন প্রজাপতি। এমনই স্বপ্নের আবেশে মন ডুবে যায় সিলেটের ভোলাগঞ্জে। মন চাইলেই চোখ ফেরানোর সুযোগ নেই প্রকৃতির এই স্বর্গরাজ্য থেকে।

মনের ক্লান্তি নিমিষেই শুষে নেয় এখানকার বাতাস। তাই পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়ে সবসময় মুখর ভোলাগঞ্জের পরিবেশ। ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটকের মন কেড়ে নেয় দূর থেকেও। তাই চলুন জেনে নিই সাদা পাথরের ভোলাগঞ্জের সাত সতের।

ভোলাগঞ্জ, সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। মেঘালয়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা ধলাই নদীর পাড়ে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গ্রাম। পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝর্ণার পানি জমে জমে সৃষ্টি হয়েছে এই ধলাই নদীর।

মেঘালয়ের পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে বহু জনপদ মারিয়ে বাংলার মাটিকে করেছে গর্বিত ধলাই নদী। ধলাই উজান থেকে বয়ে নিয়ে আসে প্রতি মুহূর্তেই মূল্যবান সাদা পাথর। গঠনবিচারের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর খুবই উচ্চমানের। এই পাথর ধলাই নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব যেমন অপরিসীম করে তোলেছে তেমনি ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে সিলেটের সীমান্ত গ্রাম ভোলাগঞ্জকেও।

এ নদীর একাধিক নাম। কেউ বলে ধলই আবার কারো কাছে ধলাই নদী। পাহাড়ী নদী বলেই সমতলের অন্য নদীর মতো ধলাই নদীর গভীরতা খুবই কম।

ঋতুভেদে কখনো থাকে হাটুজল, কখনো কোমর কিংবা কখনো কখনো ৪ফুট পর্যন্ত পানি ধরে রাখে এই শ্বেত পাথরের নদী। ধলাইয়ের বুকে জমে আছে অগণতি সাদা পাথর আর জলে ভাসে ভারকি নৌকা। সাত তক্তায় তৈরি বিশেষ ধরণের এই নৌকা দেখতে অনেকটা বাইচের নৌকার মতেই।

সিলেট শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভোলাগঞ্জ। ভারতীয় পাহাড়ি ঢল বয়ে নিয়ে আসে নবীন প্লাইস্টেসিন ও হলোসিন যুগের কঠিন সুগঠিত পাথর যা ধলাই নদীকে পাথরের খনিতে পরিণত করেছে।

এসব পাথর আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলায় গঠিত। নদীর বুকে বয়ে চলায় পাহাড়ি শীতল জলের ধারা শুধু ধলাইকেই সমৃদ্ধ করেনি তৃপ্ত করে চলেছে লাখো পর্যটকের মন। তাই বছরের বেশিরভাগ সময় ভোলাগঞ্জে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে।

পাহাড়ি ঝর্ণা ধলাই নদীর পানি আর সাদা পাথরের একমাত্র উৎস হলেও কোথাও এসেছে মনু নদীর জল। দুয়ে মিলে বয়ে নিয়ে চলা শান্ত জলের ধারা সমর্পন করেছে কুশিয়ারা নদীতে। ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট এলাকাজুড়ে প্রকৃতি যেন বিছিয়ে রেখেছে সাদা পাথরের জমিন।

সীমান্তবর্তী ধলাই নদীর ১০ নম্বর ঘাট ধরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সামনে এগিয়ে গেলেই মিলবে আরো বিস্তীর্ণ পাথরের এলাকা। কেউ কেউ এলাকাকে সাদা পাথর নামেও পরিচয় করিয়ে দেয়।

সাদা পাথর দেখার উপযুক্ত সময় কখন?

হাওরে ভ্রমণ করার উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। তবে বছরের যে কোন সময়ই আপনি ভ্রমণ করতে পারেন ভোলাগঞ্জে। ঋতুভেদে ভোলাগঞ্জ আর ধলাই নদী একেক রূপে আবির্ভূত হয়। পর্যটক হিসেবে বছরের যে কোন সময় আপনার মন ভরিয়ে দিতে পারে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর আর ধলাইয়ের শান্ত, শীতল জল। তবে চঞ্চলা ধলাই নদী আর সাদা পাথর দেখার উপযুক্ত সময় পূর্ণ বর্ষা।

তখন দু’কূল ছাপিয়ে বয়ে চলে ধলাই নদী। বুকে বয়ে নিয়ে চলে ছোট বড় সাদা পাথর ভাটির দিকে। তবু তখনও দেখা মিলবে সাদা পাথরের। অর্ধ ডুবন্ত বড় বড় পাথরগুলো দেখে মনে হবে যেন স্নান করছে ধলাইয়ের শীতল জলে।

পাথর আর জলের এমন মিতালী আর কোথাও খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একসাথে বয়ে চলার কল্লোলে বাজে সুরের মুর্চ্ছনা, বাজবে আপনার হৃদয়ও। পাথরের গায়ে ধ্যানী বুদ্ধের মতো বসে তুলে নিতে পারবেন আলোকচিত্র যা আপনার স্মৃতির পাতায় ছবি হয়ে থাকবেই জনমভর।

প্রকৃতির এ প্রেম মানুষ কখনো ভুলতেই পারে না। বর্ষার খানিক পরে গেলে ভোলাগঞ্জকে দেখবেন অন্যরকম মোহনীয় রূপে। তখন যে দিকেই তাকাবেন দৃষ্টির সীমানায় শুধু সাদা আর সাদা পাথর।

কিভাবে যাব ভোলাগঞ্জ?

দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে প্রথমেই আসতে হবে সিলেট শহরে। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক, রেল কিংবা আকাশপথে আসতে পারেন সিলেট।

ঢাকার সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর, শ্যামলী, ফকিরাপুল, আরামবাগ ও কলাবাগান থেকে সহজেই পেয়ে যাবেন সিলেটগামী অনেক বাস। গ্রীনলাইন, শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ কিংবা এনা পরিবহনে চড়ে বসতে পারেন সন্ধ্যা ৬টার পর যে কোন ট্রিপে।

সাদা পাথর
Volaganj

ঢাকা থেকে সিলেট আসতে সময় লাগবে ৫-৬ ঘণ্টা। ভাড়া নন এসি বাসে ৫০০-৬০০ এবং এসি বাসে ৮০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে জনপ্রতি।

এছাড়া কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেন নিয়মিত সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসছে ভাড়া এবং সময় প্রায় বাসের মতোই। তবে আপনি যদি আকাশপথে আসতে চান সেক্ষেত্রে সময় লাগবে ৩০-৪০ মিনিট এবং খরচ হবে ৩০০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত।

সিলেট শহরে নেমে গেলে ধরে নিন চলেই এসেছেন ভোলাগঞ্জ। শহর থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভোলাগঞ্জ। যাওয়ার বাহন হিসেবে থাকছে বিআরটিসির বাস কিংবা সিএনজি। এছাড়াও যে কোন শেয়ার মাইক্রোবাসেও যেতে পারেন তা সম্পূর্ণই আপনার স্বচ্ছন্দের উপর নির্ভর করবে।

হযরত শাহজালাল র. এর মাজার গেট থেকে বিআরটিসির বাসে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। নামতে হবে জিরো পয়েন্টে। সিএনজিতে শেয়ার করে গেলে ভাড়া পড়বে ১২০-১৫০ টাকা এবং আসা যাওয়া রিজার্ভ করে গেলে ভাড়া পড়বে ১২০০-১৩০০ টাকা।

সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলাচল করে বিআরটিসি। সিএনজিতে গেলে রিজার্ভ করে যাওয়াই ভালো কারণ ফেরার পথে অনেক ক্ষেত্রেই সিএনজি পাওয়া মুশকিল হলে পড়ে। তবে যেভাবেই যাবেন সময় লাগবে কমবেশি এক ঘন্টা।

ভোলাগঞ্জ বাজারে পৌঁছে ১০ নম্বর ঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে যেতে হবে সাদা পাথরের দেশে। ১০ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নৌকার ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা। যে বাহনে চড়বেন মনে রাখবেন ভাড়া অবশ্যই আগে থেকে দরাদরি করে ঠিক করে নিতে হবে।

ভোলাগঞ্জে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থ

ভোলাগঞ্জ প্রত্যন্ত গামীণ এলাকা তাই থাকা ও খাওয়ার সু-বন্দোবস্ত নেই বললেই চলে। তবে ভোলাগঞ্জ যাওয়ার পথে কোম্পানীগঞ্জ বাজার থেকে খেয়ে যেতে পারেন কিংবা দুপুরের খাবার সাথে করে নিয়েও যেতে পারেন। খাবার সাথে নিয়ে গেলে অবশ্যই খাবারের প্যাকেট যত্রতত্র ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।

যদি হালকা খাবার খেয়ে থাকতে পারেন তবে সিলেট শহরে এসে পেট পুরে ভুরি ভোজন করতে পারবেন। এখানে পাবেন বিভিন্ন মানের এবং স্বাদের বেশ অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট।

বেশিরভাগ ভালো মানের রেস্টুরেন্টের অবস্থান শহরের জিন্দাবাজার এলাকায়। সিলেট শহরের উল্লেখযোগ্য রেস্টুরেন্টের মধ্যে রয়েছে পাঁচ ভাই, পানশি, পালকি। তার মধ্যে পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট স্বাদে ও মানে সুপরিচিত। একবার টেস্ট করে দেখতেই পারেন।

ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর দেখতে গেলে থাকার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। শহরতলীর কাছে হওয়ায় দিনে দিনেই ফিরে আসা যায় শহরে। এখানে ১০০০-২০০০ টাকায় পেয়ে যাবেন ভালো মানের হোটেল। সেক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখবেন পর্যটক হিসেবে আম্বরখানা এলাকায় থাকা অনেক সুবিধাজনক হবে। কারণ এখান থেকে যে কোন দিকে যাতায়াতের সু-বন্দোবস্ত রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *