নিকলী হাওর বর্ষায় ভ্রমণের সেরা গন্তব্য

নিকলী হাওর (Nikli Haor) বর্তমান সময়ে হাওর ভ্রমণের এক অন্যতম আকর্ষণ। বাইকার থেকে শুরু করে একক ভ্রমণ কিংবা পরিবার নিয়ে বেড়ানোর এক স্বস্তিদায়ক পর্যটন কেন্দ্রের নাম নিকলী হাওর। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি আর জলের বুকে ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম সব মিলে এক মোহনীয় এবং অ্যাডভেঞ্চারের ঠিকানা। শান্ত জলের নিকলী হাওর সবসময় এক মায়াবী আকর্ষণে কাছে টানে পর্যটকদের। কখনো তীব্র বাতাসে ফুলে উঠা উন্মাদ জলরাশি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের হাতছানি দিয়ে ডাকে অহর্নিশ।

কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অধ্যুষিত এলাকা নিকলী। বছরের বেশিরভাগ সময় জলমগ্ন আবাদি জমি বর্ষায় অন্যরূপে জাহির করে মানুষের কাছে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, জেলা শহরের সাথে নিকলীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো ভয়ানক খারাপ। বেরিবাধ সংস্কার ও নতুন সড়ক নির্মাণ নিকলীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। প্রথমে স্থানীয় স্পীডবোটে ভ্রমণ করাই স্থানীয়ভাবে নিকলী হাওরের প্রধান আকর্ষণ ছিলো। ধীরে ধীরে বহিরাগত পর্যটকদের আগমনে নিকলী হয়ে উঠে অন্যরকম পর্যটন কেন্দ্র।

পর্যটনের সুবাদে প্রতিদিন বদলাচ্ছে নিকলী ও নিকলী হাওর। প্রতিনিয়তই বাড়ছে নানা সুযোগ সুবিধা। নিকলী হাওর নামে পরিচিত হলেও এই পর্যটনের সাথে একই সুতোয় গাঁথা নিকলী-ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম। এই চারটি উপজেলা সমানহারে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। হাওরের বুক চিরে বয়ে চলা মসৃণ পিচঢালা পথ পাখির চোখে দেখলে সত্যিই স্বর্গীয় মনে হয়। হাওরের বাহারি রকমের তাজা মাছ, নৌকা ভ্রমণ ছাড়াও পূর্ণিমায় রাতভর জলবিহার যে কারো মনে সারাজীবন দাগ কাটার মতো স্মৃতি হয়ে থাকবে।

নিকলী হাওর কখন যাবেন ?

হাওর প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের আধার। বর্ষায় পূর্ণ যৌবনা আর শুকনো মৌসুমে সবুজের খনি। দুই সময়ে দুই ধরণের আবেশ কাজ করে মনে। তবে সবসময় ক্লান্ত মনে প্রশান্তির অনুভূতি সঞ্চারে যে কোন হাওরের রয়েছে মায়াবী শক্তি। বর্ষায় নিকলী হাওর আপনাকে দেবে জলের আনন্দ। শীত মৌসুমে পানি কমে গেলে মাঠে মাঠে রোপন করা হয় সোনালী ধান। খোলা বাতাস ধানের শীষে খেলা করে প্রতি মুহূর্ত। পাকা ধানের শীষে প্রজাপতি, ঘাসফড়িংয়ের চঞ্চল বয়ে চলা অবশ্যই আপনার মনে শিহরণ জাগাবে। তাই বছরের মে/জুন থেকে শুরু করে নভেম্বর/ডিসেম্বর পর্যন্ত যে কোন সময় ঘুরে বেড়াতে পারেন নিকলী হাওরে।

ঢাকা টু নিকলী হাওর

ঢাকা থেকে নিকলী হাওরে যাওয়ার বিভিন্ন উপায় রয়েছে। বাইক, বাস ও ট্রেনযোগে ৩-৫ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় মূল হাওরে। রাজধানীর মহাখালী, সায়েদাবাদ, গোলাপবাগ থেকে বাসে আসতে হবে ভৈরব, কটিয়াদী, পুলেরঘাট অথবা কিশোরগঞ্জ শহরে। এ পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া গুণতে হবে নন এসি বাসে ২০০-২৫০ টাকা এবং এসি বাসে ৪০০-৫০০ টাকা। ভৈরব থেকে নিকলী হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া গুণতে হবে ১০০-১৫০ টাকা। কটিয়াদী থেকে থেকে সিএনজিতে ৬০ টাকা, পুলেরঘাট থেকে অটো রিকশায় ৬০ টাকা এবং কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সিএনজিতে জনপ্রতি ৮০ টাকা। প্রত্যেক রুটে সময় লাগবে কমবেশি এক থেকে দেড় ঘণ্টা।

ট্রেনে নিকলী হাওর

রাজধানীর কমলাপুর এবং বিমানবন্দর থেকে ট্রেনযোগে আসা যাবে কিশোরগঞ্জ। সে ক্ষেত্রে আপনাকে নামতে হবে সরারচর, মানিকখালী, গচিহাটা কিংবা কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনে। সরারচর থেকে নিকলী আসতে সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ৬০ টাকা এবং সময় লাগবে আধা ঘণ্টা, গচিহাটা এবং মানিকখালী থেকে সিএনজি কিংবা অটোরিকশায় সময় লাগবে আধা ঘণ্টা ভাড়া ৪০-৫০ টাকা, কিশোরগঞ্জ থেকে যথারীতি বাসে আসার মতোই সুযোগ সুবিধা থাকবে। কমলাপুর থেকে এগারসিন্দুর প্রভাতী সকাল ৭:১৫ কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে যা কিশোরগঞ্জ পৌঁছায় ১১টায় এবং গোঁধুলি সন্ধ্যায় ৬:৩০ মিনিটে ছেড়ে ১১টার মধ্যে কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। সপ্তাহে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন চলাচল করে ট্রেনটি। কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস সকাল ১০:৩৫ মিনিটে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ২:২০ মিনিটে কিশোরগঞ্জে পৌঁছায়।

নিকলী হাওরে খাবেন কোথায়

নিকলী হাওরে ঘুরতে আসলে খাওয়ার ব্যবস্থা সবসময়ই সুন্দর পাওয়া যাবে। মাছ, মাংস, সবজি সবই পাওয়া যাবে একদম টাটকা। হাওরের বাহারি রকমের মাছের আয়োজন প্রায় সব রেস্টুরেন্টেই থাকে। হাসপাতাল মোড়েই পাওয়া যাবে আল্লাহর দান, সেতু হোটেল, গাজীপুর রেস্টুরেন্ট। এছাড়া পুরো বেরিবাঁধ জুড়েই থাকবে ছোট বড় অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। আসা এবং যাওয়ার পথে খাবার খেতে চাইলে গচিহাটা বাজারের চড়ুইভাতি রেস্টুরেন্টের স্বাদ নিতে অবশ্যই ভুল করবেন না।

চড়ুইভাতি রেস্টুরেন্ট

নাগরিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতেই মানুষের একটু অবসর পেলেই ছুটে চলে মুক্ত বলাকার মতো। ভ্রমণকালে খাবার দাবার একটি অনেক বড় অনুষঙ্গ। সাধারণ ব্যস্ত এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোও খুব বেশি ব্যস্ত থাকে, থাকে খদ্দেরদের উপচে পড়া ভিড়। স্বস্তির প্রত্যাশায় শহুরে ব্যস্ত জীবন থেকে পালিয়ে যদি ব্যস্ত রেস্টুরেন্টের ভিড়ে হাওরের স্বাদ নিতে হয় তবে তা ভ্রমণের জন্য অনেক বড় বিড়ম্বনা। পর্যটকদের আরামদায়ক ভোজনের প্রত্যাশায় চড়ুইভাতি আয়োজন করেছে এক অন্য মাত্রার রেস্টুরেন্ট। স্বস্তির শতভাগ নিশ্চতায় একবার অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন।

চড়ুইভাতি রেস্টুরেন্ট কেন ভালো?

চড়ুইভাতি রেস্টুরেন্ট সম্পূর্ণ নিরিবিলি পরিবেশে ক্ল্যাসিক ডিজাইনে প্রস্তুত করা হয়েছে। উদীয়মান এ রেস্টুরেন্ট এখনও নান্দনিকতার অনেক কিছুই সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি। তবে ভোজনপ্রেমীদের যথেষ্ট সাড়া পেয়েছে তাদের আতিথেয়তা এবং সু-স্বাদু খাবারের জন্য। সম্পূর্ণ খোলা ছাদ আর ছনের ছাউনীতে মজাদার খাবার উপভোগ করার সুযোগ খুব জায়গায় মিলে থাকে। এই রেস্টুরেন্টের উদ্যোক্তার অমায়িক ব্যবহার এবং বাহারি খাবারের পশরায় মুগ্ধ দূর দূরান্তের ভোজন রসিকরা। এখানে আপনি যে কোন ধরণের খাবার পাবেন তবে স্পেশাল মেনুর জন্য অবশ্যই আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে। এই রেস্টুরেন্টের নিয়মিত এবং জনপ্রিয় খাবার চিকেন চাপ, এছাড়া নিয়মিত থাকে চাউলের রুটি, গরুর গোস্ত, বিফ বিরিয়ানী, অত্যন্ত সু-স্বাদু মোরগ পোলাও, স্পেশাল জিরা পানি, ভাত, বাহারি রকমের ভর্তা, ফলের জুস, লাচ্ছি, ফালুদা এবং কোমল পানীয়। আপনি যে কোন খাবার খেতে চাইলে আগে থেকে অর্ডার করলে তা প্রস্তুত করে দেবে। চড়ুইভাতি অর্ডার ছাড়া কোন খাবার প্রস্তুত করে না। তাদের শ্লোগান হলো বিশুদ্ধ খাবারের ঠিকানা। এতে সহজেই বুঝা যায় চড়ুইভাতি বাসি কিংবা পচাঁ খাবার বিক্রি করে না। গ্রুপ ট্যুরে আসলে অবশ্যই একবার স্বাদ নিতে পারেন চড়ুইভাতির। তাদের ফেসবুক পেজে কিংবা সরাসরি ফোন করেও অগ্রিম বুকিং দিতে পারেন। বুকিংয়ের জন্য ০১৬৪৩৬১৬৬৮০, ০১৬৪৩৬১৬৬৮১ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন। বিশাল ছাঁদে এ রেস্টুরেন্ট হওয়ায় একসাথে ১০০-১২০ জন বসে খেতে পারবে।

নিকলীতে থাকার ব্যবস্থা

সবার পরিচিত চেয়ারম্যান গেস্ট হাউস নিকলীর সবচেয়ে নিরাপদ থাকার ঠিকানা। এছাড়াও বর্তমানে আরও নতুন কিছু আবাসিক হোটেল গড়ে উঠছে। তাছাড়া উপজেলা ডাক বাংলোতেও থাকা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *