তাজহাট জমিদার বাড়ি। রংপুরের ঐতিহাসিক স্থাপনার একটি এই বাড়ি। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে ইতিহাস। মুদ্রিত কালো অক্ষরগুলোও ধূসর হয়ে গেছে অবহেলায়। বইয়ের পাতায় ইতিহাস মানুষকে আকৃষ্ট না করলেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো মানুষ যেন চোখে হারায়। খুব বেশি পুরনো না হলেও রংপুরের শতবছরের ইতিহাসের নাম তাজহাট জমিদার বাড়ি।
মাহিগঞ্জ উপজেলায় নির্মিত এই বাড়ি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে স্থানীয় মানুষের কাছে রংপুরের জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র। স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৪-১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই বাড়ি সুপ্রিম কোর্টের ব্রঞ্চ হিসেবে ব্যবহার হতো। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রীয় প্রত্নতত্ত্ব হিসেবে তালিকাভূক্ত হয় বাড়িটি। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছে। ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরটি এই বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়।
তাজহাট জমিদার বাড়ির ইতিহাস
মান্নালাল ছিলেন একজন রত্ন ব্যবসায়ী। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ব্যবসায়িক কারণে তিনি রংপুরের মাহিগঞ্জে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন নি:সন্তান। তার মৃত্যুর পর তার পালিত পুত্র গোপাল লাল তার ব্যবসার হাল ধরেন। গোপাল লাল অনেক পরিশ্রম করে ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটান। এ সময় তিনি প্রচুর ধন সম্পত্তিও অর্জন করে। এক পর্যায়ে গোপাল লাল রায় বাহাদুর জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ২০০০ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত হয় তাজহাট জমিদার বাড়ি। বাড়িটি নির্মাণ করতে সময় লাগে ১০ বছর। তৎকালীন সময়ে এ বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিলো প্রায় দেড় কোটি টাকা। ১৯১৭ সালে জমিদার বাড়ির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিলো। জনশ্রুতি আছে মহারাজা কুমার গোপাল লালের মহামূল্যবান ও নান্দনিক মাথার তাজ (মুকুট) থেকেই এই এলাকার নামকরণ হয় তাজহাট। মোঘল স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত এই বাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশি নির্মাণ উপকরণ। জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ইতালীয় মার্বেল পাথরে সন্নিবেশিত সিঁড়ি। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই জাদুঘর। এখানে সংরক্ষিত আছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন। সংস্কৃত এবং আরবি ভাষার অতি প্রাচীন কিছু পাণ্ডুলিপিও আছে যত্নে রাখা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ের মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মহাভারত ও রামায়নের আদি সংস্করণের কিছু কপিও রয়েছে। থরে থরে সজ্জিত আছে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর কালো পাথরের মূর্তি। তাজহাট জমিদার বাড়ি দেখতে রাজধানীর আহসান মঞ্জিলের মতো। লাল ইট, শ্বেত ও চুনা পাথরে নির্মিত এ বাড়িটি চারতলা বিশিষ্ট। বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সংরক্ষিত আছে জমিদার গোপালের ব্যবহৃত জিনিসপত্র।
তাজহাট জমিদার বাড়ি দেখলেই বুঝা যায় মহারাজা গোপাল লালের উদারতার কথা। বাড়ির সামনের খোলা মাঠ, মাঠের পাশে সারি সারি সাজানো গাছ আর পুকুর রাজার কথাই জানান দেয়। জমিদার বাড়ি ভ্রমণের সময় দর্শনার্থীদের গাড়ি রাখার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। ২০ টাকার টিকিট মূল্যে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সপ্তাহে ৫ দিন পূর্ণ দিবস খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ রবিবার। সোমবার অর্ধদিবস খোলা থাকে।
তাজহাট জমিদার বাড়ির স্থাপত্যশৈলী
জমিদার বাড়িটি ২১০ ফুট প্রশস্ত। ছাদে রয়েছে গম্বুজ ও কোণায় অষ্টভুজাকৃতি ছোট ছোট মিনার। প্রবেশের সিড়িতে ও দ্বিতীয় তলার মেঝেতে ব্যবহৃত ইতালীয় মার্বেল পাথর এই রাজবাড়ি অন্য রাজবাড়ি থেকে আলাদা করেছে। বাড়ির পেছন দিকে রয়েছে একটি গুপ্ত সিঁড়ি যা কোন সুড়ঙ্গের সাথে যুক্ত। ধারণা করা হয় এ সুড়ঙ্গ ঘাঘট নদীর সাথে যুক্ত। কালক্রমে অবহেলায় বাড়ির সামনের ফোয়ারাটি কিছুটা মলিন হলেও শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথর ও সবুজাভ নকশায় অতীতের জৌলুশ পরিস্কার দৃশ্যমান। জনশ্রুতি আছে রাজা তার রানীর জন্যই এই ফোয়ারা নির্মাণ করেছিলেন।
প্রাসাদের খোলা প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ইংরেজি ইউ আকৃতির। প্রবেশ পথের বাইরে নিচতলায় ১৮*১৩ মিটার একটি হল রয়েছে। হলরুম থেকে উপরে উঠার জন্য দুটি প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। প্রসাদটিতে মোট ২২টি কক্ষ রয়েছে।
কিভাবে যাবো তাজহাট জমিদার বাড়ি?
রাজধানী ঢাকা থেকে রংপুরের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ছেড়ে যায় বিভিন্ন গণপরিবহন। গাবতলী, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর, আব্দুল্লাহপুর ও ফকিরাপুল থেকে প্রতিদিন দিবা ও রাত্রিকালীন কোচ চলাচল করে। ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ৫০০-১০০০ টাকা। এসি ও নন এসি এবং গাড়ির সুবিধা অনুযায়ী ভাড়া কমবেশি হতে পারে। ঢাকা থেকে রংপুরগামী এস আর ট্রাভেলস, শ্যামলী পরিবহন, এনা পরিবহন, টি আর ট্রাভেলস, নাবিল, গ্রীনলাইন এবং হানিফ এন্টারপ্রাইজ উল্লেখযোগ্য। রংপুর শহর থেকে তাজহাট জমিদার বাড়ি যেতে অটোরিকশায় আরও লাগবে ২০ টাকা। কুড়িগ্রামগামী গাড়িতে চড়লে জমিদার বাড়ির সামনেই নামা যাবে।
থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা
তাজহাট জমিদার বাড়ি ভ্রমণে রংপুর শহরেই থাকতে পারবেন আরামদায়ক পরিবেশে। রংপুরের রাত্রিযাপনের জন্য হোটেল ও মোটেলগুলোর মধ্যে নর্থ ভিউ, পর্যটন মোটেল, দি পার্ক হোটেল, হোটেল তিলোত্তমা উল্লেখযোগ্য। খাওয়ার জন্য হোটেলের আশপাশেই মিলবে বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট। তবে রংপুরের স্থানীয় এবং বিখ্যাত খাবারের স্বাদ নিতে অবশ্যই ভুল করবেন না। ঘোষ ভাণ্ডারের মিষ্টি, সিঙ্গারা হাউজের সিঙ্গারা এবং নাড়ুর দোকানের চায়ের স্বাদ অবশ্যই নিতে পারেন। এছাড়া গ্রীষ্মকালে রংপুর গেলে হাড়িভাঙ্গা আমের কথা বলতেই হবে না।
বি:দ্র: জাদুঘরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ভ্রমণে অবশ্যই ছবি তোলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য নিজ দায়িত্বে ক্যামেরা ও মোবাইল টিকিট কাউন্টারে জমা রাখুন। অবশ্য এসব জায়গায় এ ধরণের নির্দেশনা কর্তৃপক্ষও দিয়ে থাকেন। যত্রতত্র ময়লা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন।