টাঙ্গুয়ার হাওর রূপসী বাংলার জলের এক অন্য দিগন্তের নাম। হাওর, বাওড়, নদীর দেশ বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর দেশ হলেও বছরের বেশিরভাগ সময় বর্ষার দাপট থাকে বাংলাদেশে। সারা বছরই প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন রুপে সেজে ওঠে। তবে বর্ষাকালীন সাজে বাংলার প্রকৃতি সত্যিই এক অনন্য রূপে দেখা দেয়। কাছ থেকে বাংলার অপূর্ব সৌন্দর্য দেখার এটিই উৎকৃষ্ট সময়। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের পিপাসা মেটাতে অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশের গ্রাম, গঞ্জ, আর পর্যটন কেন্দ্রগুলো। বর্ষায় বিশেষত রুপের পসরা বিলায় হাওরাঞ্চল। হাওর বেসিন বাংলাদেশের সেই রূপের খনি।
পূর্বে সুনামগঞ্জ, মৌলবীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা নিয়ে বিস্তৃত যে হাওর তা-ই হাওর বেসিন নামে পরিচিতি। হাওর বেসিনে রয়েছে একাধিক ছোট হাওর। বছরের যে কোন সময় ভ্রমণের জন্য সবগুলো হাওরের নিজস্বতা থাকলেও টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় হাওর।
টাঙ্গুয়ার হাওর কোথায় অবস্থিত?
এই প্রশ্নটি বর্তমান সময়ে একেবারেই বেমানান প্রশ্ন। সারাদেশের পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে টাঙ্গুয়ার হাওর অত্যন্ত সুপরিচিত এক নাম। চায়ের স্বর্গ সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত যে হাওর তা-ই টাঙ্গুয়ার হাওর। এটিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। তবে নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামে স্থানীয়দের কাছে এ বিলের পরিচিতি ব্যাপক। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বিরাজমান টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের আকাশের নিচে এ যেন আরেক মহাশূন্য। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজার ৫১টি হাওর মিলে একীভূত হয়ে নাম হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের। সবমিলে এই হাওরের আয়তন প্রায় ৯,৭২৭ হেক্টর। চারদিকে জলবেষ্টিত এই হাওরের ২৮ বর্গকিলোমিটার মূলত জলাভূমি এবং বাকী অংশ বসতি ও আবাদি জমি। তবে বর্ষায় বসতি বাদে সবটুকুই জল থৈ থৈ।ভারতীয় পাহাড়ের ৩০টিরও বেশি ছড়া বা ঝর্ণার নির্মল জলধারা টাঙ্গুয়ার হাওরকে দিয়েছে বাড়তি সৌন্দর্য। সঙ্গত কারণে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ’প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই এই হাওরের ৬০ বছরের ইজারা প্রথার সমাপ্তি ঘটে। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে রামসার স্থান হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হয়। তখন থেকেই আইসিইউএন টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র রক্ষায় কাজ করছিলো। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৯ নভেম্বর থেকে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
কমবেশি সারাবছরই টাঙ্গুয়ার হাওরে ভিড় থাকে পর্যটকদের। বর্ষায় জল আর শীতের অতিথি পাখিরা প্রকৃতিপ্রেমীদের তীব্র আকর্ষণে কাছে টানে। দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের পদভারে এ দুই সময় মুখর থাকে হাওরের পরিবেশ। কেউ একা কিংবা দলবদ্ধ পর্যটকরা পাড়ি জমায় জলের বুকে ভাসতে। বর্ষায় দেশের অন্যান্য পর্যটনের তুলনায় হাওড়ে পর্যটকের ভিড় তাই একটু বেশিই চোখে পড়ে।
কেন জনপ্রিয় টাঙ্গুয়ার হাওর? প্রশ্নটি যেমন সহজ উত্তরও তেমনি সহজ। প্রায় সব ঋতুতেই টাঙ্গুয়ার হাওরের রয়েছে বিশেষ বিশেষ আকর্ষণ। বর্ষায় বিস্তীর্ণ জলরাশি কিংবা শীতে পরিযায়ী পাখিদের মেলা দুই কারণেই টাঙ্গুয়ার হাওর খুব বেশি জনপ্রিয়। প্রকৃতির এত বৈচিত্র সুন্দরবন ছাড়া একমাত্র এখানেই মিলবে। ২০১৯ সালের পাখি শুমারী অনুযায়ী প্রতিবছর দেশি-বিদেশি প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায় এই হাওরে। এছাড়াও ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২০ প্রজাতির সাপ, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২০০ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১০০০ এর বেশি প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণি সমৃদ্ধ করেছে হাওরের জীববৈচিত্রকে।
জলবিহার ছাড়াও ভ্রমণ পিপাসুদের মন ভরিয়ে দিতে আরও অনেক কিছুই রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। জলবিহারের পাশাপাশি উপভোগ করার মতো রয়েছে জলাবন (জলমগ্ন বন), শহীদ সিরাজ লেক যা নিলাদ্রি লেক নামে পরিচিত, বারিক টিলা, যাদুকাটা নদী, লাউড়ের গড়। সাথে বাড়তি পাওনা হিসেবে থাকবে মায়াবী সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়।
টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার উপায়
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেটগামী বাস রয়েছে। বাসযোগে সিলেট হয়েও সুনামগঞ্জ যাওয়া যাবে। রাজধানী ঢাকা থেকে আসতে হলে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল হবে সবচেয়ে বড় জংশন। সায়েদাবাদ থেকে সিলেটগামী বাস পাওয়া যাবে যত্রতত্র। এছাড়াও মহাখালী, ফকিরাপুল, গাবতলী কল্যানপুর, শ্যামলী, কলাবাগান, আরামবাগ এমনকি আব্দুল্লাহপুর থেকেও সিলেটগামী বিভিন্ন বাসা পাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাতে জনপ্রতি ভাড়া গুণতে হবে নন এসি বাসে ৫০০-৬০০ টাকা এবং এসি বাসে ১২০০-১৪০০ টাকা। বাসে যেতে সময় লাগবে কমবেশি ৫-৭ ঘণ্টা। জনপ্রিয় বাসগুলোর মধ্যে শ্যামলী পরিবহন, এনা পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, গ্রীনলাইন এবং ইউনিক উল্লেখযোগ্য।
রাজধানীর কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেল স্টেশন থেকে ট্রেনযোগে যাওয়া যাবে সিলেট। প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় বেশ কয়েকটি ট্রেন। পারাবত এক্সপ্রেস (৭০৯) সকাল ৬:২০ মিনিটে ছেড়ে সিলে পৌঁছায় দুপুর ১টায়, মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস(৭১৭) কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই যাত্রার সময় ১১:১৫ এবং সিলেট পৌঁছায় সন্ধ্যা ৭টায়। উপবন এক্সপ্রেস (৭৩৯) ছেড়ে যায় রাত সাড়ে ৮টায় এবং পৌঁছায় ভোর ৫টায়, বুধবার ট্রেনটির সাপ্তাহিক ছুটি। কালানী এক্সপ্রেস (৭৭৩) সপ্তাহে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন বিকেল ৩টায় যাত্রা করে রাত ৯টায় সিলেট পৌঁছায়। সুরমা এক্সপ্রেস (০৯) রাত ১০:৫০ ছেড়ে পৌঁছায় পরদিন দুপুর ১২:১০ মিনিটে, সুরমা এক্সপ্রেস সপ্তাহে প্রতিদিন চলাচল করে।
সিলেট শহর থেকে যেকোন ভাবেই যাওয়া যাবে সুনামগঞ্জ। লোকাল কিংবা সিটিং বাস, সিএনজি তো আছেই। সিটিং সার্ভিস বাসে সুনামগঞ্জ যেতে সময় লাগবে কমবেশি ২ ঘণ্টা এবং ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। মাইক্রোবাস কিংবা সিএনজিতে ভাড়া গুণতে হবে দেড় থেকে দুইশ। নগরীর কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড কিংবা শাহজালাল মাজারগেট থেকে সুনামগঞ্জগামী পরিবহন সহজেই পাওয়া যাবে। বর্ষাকালে সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে সুরমা ব্রিজ সংলগ্ন সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে লেগুনা, সিএনজি কিংবা বাইকে চড়ে যাওয়া যাবে মূল হাওরে। বর্ষা মৌসুমে ঘুরতে গেলে তাহিরপুর বাজার থেকেই মিলবে নৌকা। তবে শীত মৌসুমে পানি কম থাকায় যেতে হবে সোলেমানপুর পর্যন্ত। সেখান থেকে নৌকাযোগে ভাসতে পারবেন হাওরে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার ব্যবস্থা কি?
টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তবুও যা আছে তা একেবারেই সীমিত সুযোগের। হাওরে প্রধানত থাকার ব্যবস্থা নৌকায়। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের জন্য নৌকায় রাত্রিযাপন একদম ঠিকঠাক। যারা পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাবেন তাদের এ বিষয়ে আগে থেকেই ভাবতে হবে। এ হাওরে থাকার মতো একমাত্র ভরসা হলো টেকের হাটের হাওর বিলাস। এছাড়া সুনামগঞ্জে ৫০০-২০০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন মানের হোটেল, গেস্ট হাউজ তো আছেই।
টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকা ভাড়া কত?
টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে এসে সবচেয়ে বেশি জটিলতার মুখোমুখি হবেন এক্ষেত্রে। নৌকার ভাড়া কত হবে তার কোন নির্দিষ্ট পরিমাপক নেই। মাঝিরা যার কাছ থেকে যেমন নিতে পারেন। তাই আপনারাও দরদাম করে যত কমে নিতে পারেন সেটিই ভালো। তবে যাওয়ার আগে ধারণা থাকলে দরদাম করতে অবশ্যই অনেক সুবিধা হবে। নৌকার ভাড়ার সাথে অনেকগুলো সম্পর্কিত বিষয় আছে যেগুলো আপনাকে আগে ভাবতে হবে। আপনি যে ধরণের সুবিধা আশা করবেন তার উপর ভিত্তি করে ভাড়া নির্ধারিত হবে তাই আপনি কি কি সুবিধা নেবেন আগে তা ভাবুন। প্রথমত জেনে নেবেন টয়লেট আছে কিনা, তারপর মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা আছে কিনা, লাইট, ফ্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের সাথে নৌকার আকার আকৃতি ও মৌসুমের উপর নির্ভর করে ভাড়া কমবেশি হবে। ছোট নৌকার ভাড়া ১৫০০-২০০০, মাঝারি নৌকার ভাড়া ২৫০০-৩৫০০ এবং ধারণক্ষমতার ভিত্তিতে বড় নৌকার ভাড়া ৬০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রে ছোট নৌকায় ৩০০০-৫০০০ এবং বড় নৌকার ভাড়া ৭০০০-১০০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এই ভাড়া শুধুই আপনাদের ধারণার জন্য। মৌসুম ও পর্যটকের চাপ কেমন তার ভিত্তিতে ভাড়া কমবেশি হবে যা আপনাকে স্পটে গিয়েই বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নৌকায় রান্নার ব্যবস্থা না থাকলে চুলা, বাবুর্চি ও আনুষঙ্গিক অন্য সবকিছু ভাড়ায় পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে নৌকার মাঝির সহযোগিতা সবচেয়ে সুবিধাজনক। নৌকায় লাইফ জেকেট না থাকলে তাহিরপুর বাজার থেকে ভাড়ায় পাওয়া যাবে। বর্ষায় নৌকা ভ্রমণে লাইফ জেকেট নিতে কখনোই অবহেলা করবেন না। অনেক ক্ষেত্রে ভালো সাঁতার জানলেও পানিতে ডুবতে পারেন। তাই নিরাপত্তার বিষয় প্রথমেই বিবেচনা করা উচিত।