স্টোনহেঞ্জ রহস্য পৃথিবীর সভ্যতার এক ঐতিহাসিক সাক্ষী। হাজার বছরের ইতিহাসের রহস্য বুকে নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে উর্ধ্বমুখী হয়ে। যেন আকাশের সাথে মিতালী গড়েছে এই স্থাপনাটি যার ভাষা আজও মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। নাছোরবান্দা মানুষও পিছু ছাড়ছে না স্টোনহেঞ্জের। অনেক গবেষণায় অনেক রহস্যের উদঘাটন হলেও কূল-কিনারা হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। হাজার প্রশ্নের উত্তর বুকে নিয়ে কালের শ্রোতে গা ভাসিয়েছে ঐতিহাসিক স্টোনহেঞ্জ।
ধারণা করা হয় স্টোনহেঞ্জ নব্য প্রস্তরযুগে নির্মিত হয়েছিলো। কে নির্মাণ করেছিলো স্টোনহেঞ্জ, কেনই বা নির্মাণ করেছিলো তার সঠিকে কোন তথ্য এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে সবই বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান আর অনুমান। ইংল্যাণ্ডের আধুনিক শহর অ্যামবারি (Amesbury) ও সালিসবারির (Salisbury) মাঝখানে এ স্থাপনাটি অবস্থিত। অ্যামবারি থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং সালিসারি থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান। বিজ্ঞানের দাবি অনুযায়ী গত ১০ হাজার বছর ধরে স্টোনহেঞ্জ বিবর্তিত হয়ে আসছে। বর্তমানে স্থাপনার যে অংশটি আমরা দেখি তা আনুমানিক ৪-৫ হাজার বছর আগে নির্মিত হয়েছিলো। তবে মূল কাঠামোটি বর্তমান ‘স্টোনহেঞ্জ’ কাঠামোর প্রায় ১৫ গুণ বড় ছিলো।
কে নির্মাণ করেছিলেন স্টোনহেঞ্জ? কিংবা কারা নির্মাণ করেছিলেন স্টোনহেঞ্জ? এই দুটো প্রশ্ন নিয়ে রয়েছে অনেক রহস্যের বেড়াজাল। শত শত পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তীও রয়েছে। গ্রীক, আটলান্টিয়ান ডেন, রোমান, সেক্সন, মিশরীয়, ফিনিসিয়ান কেল্ট এমনকি কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এলিয়েনের কথাও। আসলেই এর সঠিক কোন উত্তর নেই, শতাব্দীর পর শতাব্দী গবেষণার পর গবেষণা আর কিছু মানুষের ধারণায় বদ্ধমূল হয়েছে এগুলো ড্রুইডদের বানানো।
কে এই ড্রুইড? ড্রুইড হলো প্রাচীন কেল্টিক জাতির একজন ধর্মযাজক। এক শ্রেণীর গবেষকরা মনে করেন এই ধর্মযাজক বিভিন্ন উৎসর্গমূলক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রথমে জন অব্রে এবং পরে ড. উইলিয়াম স্টকলি, এই দুই প্রত্নতাত্ত্বিক স্টোনহেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করেন। ড. ইউলিয়াম স্টকলির গবেষণা ও প্রচারণায় ড্রইডরা বিশ্বজুড়ে স্টোনহেঞ্জের প্রস্তুতকারক জন্য খ্যাতি পেয়েছে। গবেষণা করতে করতে তিনি কেল্টিকদের সাথে এভাবেই মিশে গিয়েছিলেন তিনি নিজেও শেষ পর্যন্ত এই ধারণা থেকে বের হতে পারেননি।
তবে বেশিদিন টেকেনি উইলিয়ামের মতবাদ বা গবেষণার মূল্যায়ন। আধুনকি রেডিও কার্বন ডেটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেন কেল্টিকরা এই অঞ্চলে আসার এক হাজার বছর আগেই নির্মিত হয়েছিলো স্টোনহেঞ্জ। পরে তারা আসার পর এই স্থাপনাটিকে উপাসনা এবং উৎসর্গের কাজে ব্যবহার করতো শুধুমাত্র। আধুনিক ড্রুইডরা এখনো উপাসনার জন্য বছরে একবার গ্রীষ্মকালে স্টোনহেঞ্জে সমবেত হয়।
অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই স্টোনহেঞ্জ রসহ্য নিয়ে আধুনিক রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতির প্রতিবেদনে বিশ্বাসী। এ হিসেব অনুযায়ী স্টোনহেঞ্জ রহস্য খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছরের পুরনো। প্রথম এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলো নব্যপ্রস্তুর যুগের কৃষিজীবি মানুষরা। দ্বিতীয়বারের মতো এ স্থাপনা নির্মাণে অংশ নিয়েছিলো ইউরোপীয় বীকার জাতির লোকেরা। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে সালিসবারি সমভূমির বাসিন্দাদের উপর আক্রমণ করে বীকার জাতিগোষ্ঠী এখানে বসতি স্থাপন করে। তারা ছিলো অত্যন্ত সংগঠিত এবং খুবই মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতো। তাদের কর্মজীবনে গাণিতিক ধারণা ছিলো উন্নত মানের। বীকাররা ছিলেন সূর্যের পূজারী। তৃতীয় পর্যায়ে ওয়েজেক্স এর লোকরা স্টোনহেঞ্জ নির্মাণে হাত লাগিয়েছিলো। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্টোনহেঞ্জের ‘sarsens’ নামক পাথর গুলোতে তারাই ব্রোঞ্জের তলোয়ার অঙ্কন করেছিলো।
স্টোনহেঞ্জ রহস্য
স্টোনহেঞ্জ নির্মাণের রহস্য অনেক। এত সু্-উচ্চ পাথর প্রাগৈতিহাসিক যুগে কিভাবে বহন করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিলো এ ব্যাপারে কারো স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। ‘সারসন (sarsen)’ নামের বড় পাথরগুলোর ওজন প্রায় ২৫ জন। ধারণা করা হয় ৩২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত মার্লবরো (Marlborough) নামক এলাকা থেকে এই পাথর সংগ্রহ করা হয়। ছোট যেন নীল পাথর সেগুলো ব্লু-স্টোন হিসেবেই পরিচিত। এগুলোর ওজন প্রায় ৪ টন। ব্লু-স্টোনগুলো ২২৫ কিলোমিটার পশ্চিমের ওয়েলস থেকে আনা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। প্রশ্ন হলো এত দূর থেকে এই বড় বড় পাথরগুলো কোন প্রযুক্তি ছাড়া কিভাবে বহন করে আনা হয়েছিলা। প্রাচীন স্থপতিরা এর সাথে যুক্ত ছিলো কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত কোন তথ্য নেই বিজ্ঞানের কাছে তবে কোন কোন বিজ্ঞানী ধারণা করেন এক দল লোক মিলে কাঠের ট্র্যাকওয়ে তৈরি করে এই পাথরগুলো বহন করে নিয়ে আসা হয়েছিলো। ধারণা আর বাস্তব এক নয় তাই স্টোনঞ্জে রহস্য শুধু নতুন নতুন প্রশ্নেরই জন্ম দিয়ে যাচ্ছে।
স্টোনহেঞ্জ কারা নির্মাণ করেছিলো তার সঠিক উত্তর না পাওয়া গেলেও কেন নির্মাণ করা হয়েছিলো এই প্রাচীন স্থাপনাটি তার একটি সু-স্পষ্ট ধারণা বিজ্ঞান আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
যে কারণে স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ করা হয়
বছরের পর বছর গবেষণার পর অনেক সঠিক ইতিহাস না পাওয়া গেলেও কিছু বিষয় সু-স্পষ্টভাবেই জানা গেছে। কেন নির্মাণ করা হয়েছিলো স্টোনহেঞ্জ এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা তিনটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন।
বিশ্বাসযোগ্য তিনটি কারণ হলো:
১) পবিত্র সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহারের জন্য
২) জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজের জন্য
৩) আরোগ্য লাভের স্থান হিসেবে
সম্প্রতি কয়েক বছরের গবেষণায় স্টোনহেঞ্জ ও তার আশপাশের এলাকা থেকে ৬৩ জন প্রাচীন মানুষের কঙ্কাল ও হাড় পাওয়া গেছে যা অন্তত স্টোনহেঞ্জ রহস্যের একটি দিক নির্দেশ করে যে এটি পবিত্র সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হতো।