নীল শহর মরক্কোর ঐতিহাসিক শহর। আকাশ নীল, সগর নীল, চক্ষু নীল আর মরক্কোতে রয়েছে শহর নীল। শহরের নাম শেফশেওয়েন হলে নীল শহর বা ব্লু সিটি নামেই পর্যটকদের কাছে বেশি পরিচিত। এই শহরের রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর এমনকি মানুষের পরিধেয় কাপড়েও নীলের ছড়াছড়ি। এত নীল আর কোথাও দেখা যায় না।
শহরের বাসা-বাড়ির ভেতরে বাইরে সবখানেই নীল আর নীল। সে কারণেই ‘নীল মুক্তা’ হিসেবেও এই শহরের বেশ পরিচিতি রয়েছে। নীল শহর এক ঐতিহ্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক শহর। শহরটিকে নীলাবৃত করে রাখতে শুধু স্থানীয় বাসিন্দাদেরই প্রচেষ্টা নয়, ঐতিহাসিক শহর বলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে অনেক। শহরের রূপ আর মানুষদের জীবনধারা কাছে থেকে দেখতে প্রতি বছর উত্তর মরক্কোর রিফ পর্বতমালার মধ্যযুগীয় শেফশেওয়েন শহরটিতে দেশি বিদেশি পর্যটকের ঢল নামে।
শহরের বাড়ি, ঘর, দরজা, জানালা, সিড়ি এমনকি রাস্তায় রয়েছে নীল রংয়ের পেইন্টিং। নীল আকাশ যেন শহরের বুকে নীড় পেতেছে। শহরের প্রত্যেক কোণায় কোণায় রয়েছে অপার্থিব মায়াময় মুগ্ধতা। ইন্টাগ্রাম এবং পিন্টারেস্টের কল্যাণে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নীল শহর আর তার সুখ্যাতি। খ্যাতি রয়েছে শেফশেওয়েনের বাসিন্দাদের আতিথেয়তা এবং স্থানীয় খাবারেরও।
নীল শহর পর্যটকদের মনোরঞ্জন করলেও বুকে চেপে রেখেছে প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো ইতিহাস। অনেক ঘাত প্রতিঘাত আর সুখ-দুখের স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৪৭১ সালে। তারপর অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে আধুনিক যুগে এসে রূপ নিয়েছে নীল শহর ব্লু সিটি।
তখন ১৯৩০ সাল। হিটলারের ভয়ে ইহুদিরা পালিয়ে এসে এই শহরে আশ্রয় নিয়েছিলো। তারা নিজেদের আত্মগোপনের জন্য পুরো শহরটিকে নীলে নীলাবৃত করে রেখেছিলো। নীলকে তারা মহাত্মার রঙ মনে করতেন। কেউ কেউ নীলকে আকাশ আর স্বর্গের রংও মনে করতেন। সব মিলিয়ে নীলকেই বেছে নিয়েছিলো শরণার্থী ইহুদিরা। ১৯৪৮ সালে পরিস্থিতি শিথীল হওয়ায় সব ইহুদিরা ইসরাইল চলে গেলেও রেখে গেছে নীল শহর।
যে যা-ই মনে করুক, নীলের রয়েছে বহুমাত্রিক বিশেষত্ব। কেউ কেউ মনে করেন নীল রঙ দেখলে মশারা দূরে থাকে তাই শান্তিতে বাস করা যায়। আবার কেউ কেউ মনে করে নীল রঙ ঘরকে জলের মতো শীলত রাখে। তবে যেহেতু নীল শহর ছিলো ইহুদিদের আশ্রয় শিবির তাই খোলা আকাশের সাথে নীল রং মিলিয়ে এই শহরটিকে হয়তো দৃষ্টির আড়ালে রাখতেই এমন ফন্দি।
নীল শহর শুধু নীলের জন্যই বিখ্যাত। নীল ছাড়া শহরে চোখে পড়ার মতো বিশেষ কিছুই নেই। শেফশেওয়েন শহরটির মূলত দুটি ভাগ। একটি পুরনো শহর অপরটি নতুন। সবচেয়ে বেশি নীল চোখে পড়ে পুরনো ভাগে। এই অংশটি স্থানীয়দের কাছে ‘মেদিনা’ বলেই বেশি পরিচিত। পুরনো এই শহরটি পাহাড় ঘেরা এবং অনেক পুরনো বাড়ি আছে যেগুলো পাথর কেটে করা। বাড়ির দেয়াল এবং সিড়ি দেখলে তা স্পষ্টই বুঝা যায়। সরু সরু গলিপথ নীল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। প্রথমবার ভ্রমণে মনে হবে যেন নীল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। চোখ ধাধিয়ে যাবে।
মেদিনার বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী মুসলিম। মুসলিমরাও নীল রংকে আধ্যাত্মিক বলে শ্রদ্ধা করে তাই ইহুদি চলে যাওয়ার পরও নীলের চাদর জাপটে রেখেছে পুরো শহরের গায়ে। তাই পুরনো রেওয়াজ অনুযায়ী মেদিনার গায়ে বছরে তিনবার প্রলেপ পড়ে নীলের। বসন্ত এলেই পুরো শহর অন্তত একবার নীল সাজে সজ্জিত হয়।
প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দার বসতি মিলে শেফশেওয়েনের নীল শহর। এই শহরের বেশিরভাগ মানুষ শার্ট-প্যান্ট পড়েন না। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকই পরিধান করেন। তাদের প্রধান পোশাক ‘জাবেলা’ নামের এক ধরণের বিশেষ আলখেল্লা। জীবনযাত্রার প্রতি ক্ষেত্রেই এই শহরের বাসিন্দারা তাদের ঐতিহ্যকে লালন করে আসছেন বছরের পর বছর।
তীব্র গরম কিংবা কনকনে ঠাণ্ডায় তাদের পোশাকে ঐতিহ্যের ছাপ থাকবেই। শুধু পোশাকেই নয় মানুষগুলোর জীবনের সবকিছুতেই রয়েছে বিশেষত্ব। স্থানীয়দের নমনীয় আচার-ব্যবহারের জন্য নীল শহর বিখ্যাত। খ্যাতি রয়েছে তাদের আতিথেয়তার। আধুনিক সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এখানে পর্যটক বাড়লেও উন্নত খাবার নিয়ে অতটা চিন্তিত নন শেফশেওয়েনের বাসিন্দারা। তারা স্থানীয় খাবার দাবারকেই পর্যটকের কাছে তুলে ধরেন নিজেদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে।
ভেজালমুক্ত খাবারের শহর হলো নীল শহর। এখানকার খাবারে ভোজাল নেই বললেই চলে। ফাস্টফুডের দোকান এখানে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে স্থানীয় খাবারের পশরা সাজিয়েছে শেফশেওয়েনের নীল শহর। এখানকার স্থানীয় খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টমেটো ডালের মিশ্রণে হারিরা, কুসকুস, তাঞ্জিয়া ইত্যাদি। এখানে একরাত কাটালে সকালটা শুরু করতে পারেন দারুণ মিষ্টি চা দিয়ে। তাছাড়া মধু, রুটি এবং বাহারি ফলের জুস তো আছেই।
নীল শহর খুবই শান্ত, নিরিবিলি। অন্য সব ব্যস্ত শহরের মতো এখানে নেই অতটা ব্যস্ততা। নেই যান্ত্রিক সভ্যতার কোলাহল। দিনরাত সবসময় শতভাগ নিরাপত্তায় চষে বেড়াতে পারেন শহরের অলিতে গলিতে। নীল শহর হতেই পারে আপনার নিরাপদ ভ্রমণ ঠিকানা।