চলচ্চিত্রের ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৮৬০ সালে দ্বিমাত্রিক চলমান ছবি তোলার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু তাতে চলচ্চিত্র হয় না। পরে ১৮৮০ সালে চলচ্চিত্র ক্যামেরা উদ্ভাবন করা হয় এবং তখন থেকেই চলচ্চিত্রের প্রচলন শুরু হয়। তবে চলচ্চিত্র কি? বিষয়টি আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে।
চলচ্চিত্র মানে হলো চলমান চিত্র। সাধারণত আমরা যে ছবি দেখে থাকি তা হলো স্থিরচিত্র। চলচ্চিত্র হলো এমন ধরণের ছবি বা চিত্র যা একের পর এক দৃশ্যমান হয়। ‘মোশন পিকচার’ থেকেই চলচ্চিত্রের উৎপত্তি। কুশীলবরা বাস্তবে অভিনয় করলে তা ক্যামেরাবন্দি করে নির্মাণ করা হয় চলচ্চিত্র। তবে চলচ্চিত্রের ধারণা ক্যামেরা আবিস্কারের অনেক পরে এসেছে। বাংলায় আমরা চলচ্চিত্রকে বিভিন্নভাবে আখ্যায়িত করে থাকি। চলচ্চিত্রের সমার্থক শব্দ হলো ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি এবং ফিল্ম ইত্যাদি। চলচ্চিত্রের ইতিহাস শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে।
এটি খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। শিক্ষা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে শিল্পকলার এই প্রভাবশালী মাধ্যমটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আধুনিক সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সংস্কৃতির সাথেও শিল্পকলার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। যে কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। তাই সব চলচ্চিত্রই সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। বক্তব্য বা ডায়ালগ কিংবা সাবটাইটেলের মাধ্যমে সেই সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশ ও প্রসার ঘটায় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায় শুরুর দিকে শব্দ কিংবা ভাষা যোগ করা যায়নি। সে কারণে প্রথম কয়েক বছর নির্বাক চলচ্চিত্রই ছিলো চলচ্চিত্র বিনোদনের একমাত্র উপায়।
অনেকগুলো স্থিরচিত্র খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এক ফ্রেমে উপস্থাপনের ফলেই সৃষ্টি হয় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের ইংরেজি সমার্থক শব্দ ভিডিও (Video) যা বর্তমানে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। স্থিরচিত্রের ক্ষেত্রে সাধারণত এক সেকেন্ডে আমরা এক ফ্রেমে একটিই ছবি দেখে থাকি। অথচ আধুনিক সময়ে বিভিন্ন ফ্রেম রেটে চলচ্চিত্র উপস্থাপন হয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে আমরা ২৫-২৯টি ফ্রেম পর্যন্ত দেখে থাকি। ফ্রেমরেট যত বেশি হয় ভিডিও বা চলচ্চিত্রের গুণগত মান তত ভালো হয়।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস
১৮৬০ এর দশকে জেট্রোপ এবং প্র্যাক্সিনোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে দ্বিমাত্রিক চলমান ছবি তৈরি করা হতো। ম্যাজিক লণ্ঠন আবিস্কারের পর দ্বিমাত্রিক চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছিলো। এ পদ্ধতিতে একটির পর একটি স্থিরচিত্র সন্নিবিষ্ট করে চলচ্চিত্র তৈরি করা হতো। পরে এ ধারণা থেকে অ্যানিমেশনের ধারণার উন্মেষ ঘটেছিলো।
১৮৯৪ সাল। ডিকসন যখন ছবি এবং শব্দ একসাথে ধারণের যুদ্ধ করছিলেন ততদিনে নির্বাক চলচ্চিত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আঠারো শতকের শেষের দিকে নির্বাক চলচ্চিত্র রীতিমতো মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্বাক চলচ্চিত্রই তখনকার সময় একমাত্র চলমান শিল্প মাধ্যম। তবে এ জনপ্রিয়তা বেশিদিন টেকেনি। কিছুদিন পরই ঊনিশ শতকের শুরুর দিকেই ধরণ পাল্টায় চলচ্চিত্রের।
তখনও চলমান ছবিগুলো নির্বাকই ছিলো তবে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছিলো চিত্রে। এর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের ইতিহাস আরও এক ধাপ সমৃদ্ধ হয়েছিলো। কারণ তখন অনেকগুলো ছোট ছোট দৃশ্যকে জোড়া লাগিয়ে একটি গল্পকে ফুটিয়ে তোলার একটা প্রয়াশ খুঁজে পেয়েছিলেন গবেষক ও উদ্ভাবকরা। প্রয়োজনে একই দৃশ্যের বিভিন্ন এঙ্গেল থেকেও শট নেয়া হতো। তাতে গল্পটি ফোটে উঠতো ঠিকই কিন্তু অপূর্ণতা ছিলো শুধু শব্দ সংযোজনের অভাবে। তবে মানুষের সামনে পরিবেশনে এ বিষয়টিরও ঘাটতি রাখা হয়নি সিনেমা হলে। চলচ্চিত্রে শব্দ সংযোজন করা না গেলেও বাইরে থেকে চলচ্চিত্রের সাথে শব্দের সমন্বয় করার জন্য কাজ করতো একদল বাদক। তারা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বর্ণনাভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সে অনুযায়ী সঙ্গীত পরিবেশ করতো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইউরোপে চলচ্চিত্র শিল্পটি খুব বেশি বিকশিত হতে পারেনি। এরই সাথে সাথে চলচ্চিত্রের ইতিহাস যেন থমকে গিয়েছিলো। ততদিন আমেরিকায় হলিউডের উত্থান হলেও খুব বেশি উন্নতি হয়নি। ১৯২০ এর দশকে চলচ্চিত্র ও হলিউডের থেমে থাকা অগ্রগতিতে লেগেছিলো গতির ছোঁয়া। ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ, চার্লি চ্যাপলিন, বুস্টার কিটন, এফ ডব্লিউ মার্নো এবং ফ্রিৎস ল্যাং এর মতো পরিচালক চলচ্চিত্র বিকাশে বিস্তর কাজ শুরু করেন এই দশকেই। প্রযু্ক্তির কল্যাণে এ সময় চলচ্চিত্রের শটগুলোর সাথে ঐকতান বজায় রেখে শব্দ, সঙ্গীত এবং কথোপকথন যোগ করা হয়। সবাক চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই মোড় ঘুরে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের। ইংরেজতে এগুলোকে তখন বলা হতো ‘টকিং পিকচার’ বা ‘টকি’ (talky).
তখনও চলচ্চিত্রে রঙের চিন্তা করা হয়নি। তবে সবাক চলচ্চিত্র উদ্ভব হওয়ার পর অনেক পরিবর্তন আসে বিনোদন জগতে। নির্বাক চলচ্চিত্র এবং অর্কেস্ট্র দলগুলো প্রায় হারিয়েই গেছে। তখন টেলিভিশনও ছিলো সাদাকালো। চলচ্চিত্রে রঙের সংযোজন ছিলো ব্যয়বহুল, সেকারণে রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণে সময় লেগেছিলো। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রঙিন চলচ্চিত্রই ছিলো দর্শকের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। আরও একটি বিশেষ কারণ হলো ১৯৬০ এর দশকের আগে টেলিভিশন রঙিন হয়নি। ৬০ এর দশকে টেলিভিশন রঙিন হওয়ার পর নির্মাতাদেরও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে রঙিন চলচ্চিত্র।