স্পেস টেলিস্কোপ: জেমস ওয়েবের জাদুকরী সাফল্য

স্পেস টেলিস্কোপ কি? উত্তরটি অনেকেরই জানা আবার অনেকেরই অজানা। এ ব্যাপারে কারো জ্ঞান কম থাকলেও টেলিস্কোপ সম্পর্কে জ্ঞান নেই এমন মানুষ খুবই কম। জোতির্বিজ্ঞানে টেলিস্কোপ অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়। আর সামগ্রিকভাবেই মহাকাশ গবেষণায় টেলিস্কোপের কোন বিকল্পই নেই যেন। স্পেস টেলিস্কোপ হলো এমন একটি টেলিস্কোপ যা স্পেসে (মহাকাশে) অবস্থান করে মহাকাশের অজানা সব তথ্য আমাদের দিয়ে থাকে। বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কল্যাণে আমরা সেসব তথ্য পেয়ে থাকি। এই বিশেষ যন্ত্রটি অনাগত বিশ্বের জন্য নতুন আলোর দিশারি। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সম্প্রতি আমাদের এমনই চমৎকার দেখিয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে বললে এই টেলিস্কোপের নাম ওয়েব।

তেরশ’ কোটি বছর আগে পৃথিবী মহাকাশে কেমন ছিলো তার রঙিন ছবি প্রকাশ করে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। আষ্চর্য হলেও সত্য মহাকাশে যে দৃশ্য অন্য কোন উপায়ে দেখা সম্ভব নয় টেলিস্কোপ দিয়ে তা দেখা খুব অসম্ভবও নয়। এ রকম টেলিস্কোপ এতদিন না থাকায় অনেক দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত আমরা মাহাকাশের অনেক অজানা তথ্য আমরা পাচ্ছি। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope বা JWST) কারো একক প্রচেষ্টায় তৈরি হয়নি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ছাড়াও কানাডীয় এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয়েছে ওয়েব। এর আগে হাবল নামে আরও একটি টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলো নাসা। হাবল’র উত্তরসুরী হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে ওয়েব। ওয়েব নাসার ধ্বজাধারী একটি নভোপদার্থবৈজ্ঞানিক প্রতিনিধি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় এই টেলিস্কোপ। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে ফরাসি গায়ানার কুরু শহরের গায়ানা মাহাকাশ কেন্দ্র থেকে ওয়েবকে মহাকাশে পাঠানো হয়। উৎক্ষেপণের এ কাজ সম্পন্ন করে ফরাসি বাণিজ্যিক রকেট উৎক্ষেপণ কোম্পানি আরিয়ানস্পেস। আরিয়ান রকেটের আরিয়ান উড়াল ভিএ২৫৬ (Ariane Flight VA256) ফ্লাইটে মহাকাশে যাত্রা করে ওয়েব। যাত্রার প্রায় ৩০ দিন পর মহাকাশের দ্বিতীয় লাগ্রজীয় বিন্দুতে অবস্থান নেয় জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। দ্বিতীয় লাগ্রজীয় বিন্দু হলো মহাকাশের এমন একটি স্থান যা পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। হিসেব অনুযায়ী চাঁদের চেয়েও অনেক দূরে অবস্থিত ওয়েব। লাগ্রজীয় বিন্দুতে পৃথিবী ও সূর্যের মহাকর্ষীয় লব্ধিবল এবং মহাকাশযানের কেন্দ্রাতিগ বল একে অপরকে নাকচ করে দেয়। এ অবস্থানটি সবসময়ই পৃথিবীর অন্ধকার পার্শ্ব। এখান থেকে স্পেস টেলিস্কোপ ওয়েব অবস্থান ঠিক করে পৃথিবীর সাথে সাথে সূর্যকে বছরে একবার প্রদক্ষিণ করবে।

স্পেস টেলিস্কোপ
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে ধারণকৃত পৃথিবীর ১৩০০ কোটি বছর আগের ছবি। ছবি: news.azpm

স্পেস টেলিস্কোপ ওয়েব কেন তৈরি করা হয়েছে?

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি প্রধানত দুটি বৈজ্ঞানিক উদ্দেশে তৈরি করা হয়েছে। প্রথমত মহাকাশে থাকা বিভিন্ন ছায়াপথের জন্ম ও বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং দ্বিতীয়ত, নক্ষত্র ও গ্রহসমূহের সৃষ্টিগত বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করা। মহাকাশের অনেক দূরবর্তী বিভিন্ন ও বস্তুর অবস্থান এবং সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা যাবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে। এই টেলিস্কোপে ধারণকৃত আলোর অবলোহিত বিকীরণ থেকেই পাওয়া গেছে পৃথিবী সৃষ্টির ১৩০০ কোটি বছর আগের রঙিন ছবি। মানুষের বাসযোগ্য অন্য গ্রহের সন্ধান, বর্হিগ্রহমণ্ডলীর অবস্থান এবং বিভিন্ন ছায়াপথ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে।

১৯৯৬ সাল থেকে ওয়েব তৈরির পরিকল্পনা হয়ে আসছিলো। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশ, সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে ২০২১ সালে তা সফলভাবে তৈরির পর উৎক্ষেপণও করা হয়েছে। গোটা প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিয়েছে মার্কিন মাহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নির্মাণ প্রচেষ্টার সামগ্রিক ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের গডার্ড মহাকাশ যাত্রা কেন্দ্র (Goddard Space Flight Center; GSFC)। টেলিস্কোপটি নির্মাণের মূল ঠিকাদারি দায়িত্ব পালন করে নরথ্রপ গ্রামেন কোম্পানি এবং উৎক্ষেপণের পর পরিচলনার দায়িত্ব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের। এই সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও জেমস ওয়েবের সাথে আরও অনেকেই যুক্ত ছিলো।

স্পেস টেলিস্কোপ
নির্মাণাধীন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। ছবি: wikimedia

 

কারা তৈরি করেছেন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ?

কানাডা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার অবদান ওয়েব নির্মােণে কোন অংশে কম নয়। প্রায় ১৪টি দেশ, ২৯টি মার্কিন অঙ্গরাজ্য, ৩ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানির পাশাপাশি শত সহস্র বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী এই স্পেস টেলিস্কোপ নির্মাণে কাজ করেছেন। এই প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ১০০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি যার ৯৭০ ডলার ব্যয় করেছে নাসা। নির্মাণের শুরু থেকে সাফল্যের সাথে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে মহাকাশে পাঠাতে ৩০ বছর সময় লেগেছে। নাসার দ্বিতীয় প্রশাসক, চাঁদে অ্যাপোলো অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব জেমস ই. ওয়েবের সম্মানে তার নামেই এই টেলিস্কোপটির নামকরণ করা হয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *