ওয়াইফাই বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূণ একটি অনুষঙ্গ। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা হাতের মুঠোয় পেয়েছি গোটা বিশ্বকে। বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার ও আমাদের জীবন দুয়ে মিলেই আধুনিক বিশ্ব যা জয় করেছে প্রযুক্তি। আদিম যুগ থেকে আধুনিক বিশ্ব পর্যন্ত সময়ের শ্রোতে ভেসে যায় পুরনো সবকিছুই। প্রতিনিয়তই নতুন আবিষ্কারে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মুক্ত করছে বিজ্ঞান। ওয়াইফাই আধুনিক বিশ্বের এক অভিনব আবিস্কার।
বিজ্ঞানের আকাশচুম্বী সাফল্যে সবচেেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে সভ্যতা। সভ্যতার পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আমরা বিজ্ঞানের সাফল্য দেখতে পাই। সভ্যতার উন্নয়নে বিজ্ঞান যেমন সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে একইভাবে সভ্যতা ধ্বংসের জন্যও বিজ্ঞান দায়ী। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সুফল এবং কুফল দুই-ই আছে। মানুষের আবিস্কৃত নানা প্রযুক্তি মানুষই নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞানের আবিস্কার দিন দিন বাড়বেই। গত এক দশকে বিজ্ঞানের যে আবিস্কারগুলো বিশ্বজুড়ে বহুল জনপ্রিয় এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে আজকের এই ব্লগ।
Wifi Router. photo: unsplash
ওয়াইফাই
ওয়াইফাই হলো নেট দুনিয়ার প্রাণ। এক মিনিটের জন্য সারা দুনিয়াতে ইন্টারনেট সংযোগ এবং ওয়াইফাই বন্ধ হলে অন্ধকারে ডুবে যাবে ভার্চুয়াল জগত। এক সময় এই ওয়াইফাই বা ইন্টারনেট কিছুই ছিলো না, আমরা সেদিন অন্ধকারেই ছিলাম। সহজ একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। ৩০ বছর আগে যখন আমাদের দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা নামমাত্র ছিলো, যখন ওয়াইফাই ছিলো না তখন প্রবাসে থাকা মানুষগুলো দেশে থাকা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতো চিঠিতে। কোন কোন ক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে তারা টেলিফোন এক্সচেঞ্জার কিংবা টিএন্ডটি অফিসের মাধ্যমে পরিবারের সাখে যোগাযোগ করতো। সে সুযোগও সবখানে ছিলো না। তখন প্রবাসীরা কোন সমস্যায় পড়লে বা কোন বিপদ আপদ হলে খবর আসতে আসতে অনেক ক্ষতি হতো। বর্তমানে ইন্টারনেট ও ওয়াইফাই সুবিধার সুবাদে কোন ঘটনা ঘটলে সাথে সাথেই তা ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে আর যোগাযোগ সে তো বলাই বাহুল্য। আগে শুধু টেলিভিশনে খবর দেখা ছাড়া দেশ বিদেশের খবরাখবর রাখার আর বিশেষ কোন সুযোগ ছিলো না। বর্তমানে ওয়াফাই সুবিধার জন্য মুহূর্তেই সবকিছু হাতের মুঠোয়।
ওয়াইফাই হলো লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক সিস্টেম। অর্থাৎ সহজ কথায় বললে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযোগের তারবিহীন এই সিস্টেমকে আমরা ওয়াইফাই হিসেবে জানি। সিগন্যাল আদান প্রদানের ভিত্তিতে এই পদ্ধতি কাজ করে থাকে। অর্থৎ ওয়াইফাই ডিভাইস বা রাউটার থেকে সিগন্যাল প্রদান করা হয় এবং মোবারইল, কম্পিউটার বা যে কোন ধরণের ডিভাইস যা ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয় সে ডিভাইসগুলো রাউটার থেকে প্রাপ্ত সিগন্যাল গ্রহণ করে। ওয়াইফাই ডিভাইস ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) সিস্টেমের মাধ্যমে। ইন্টারনেট প্রটোকল বা আইপি হলো ওয়াইফাই সিস্টেমের নাম্বারভিত্তিক ঠিকানা যার মানদণ্ড হলো আইইই ৮০২.১১।
ওয়াইফাইয়ের ইতিহাস
ওয়াইফাই কবে আবিস্কার হয়েছিলো এককভাবে এর উত্তর দেয়া কঠিন। তবে প্রচলিত মতে, ১৯৮৫ সালে ওয়াইফাই আবিষ্কার হয়েছিলো। আমাদের একটি বিষয় প্রায় সকলেরই জানা, তারবিহীন যে কোন যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টিতে তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। রেডিও, মোবাইল, ওয়্যারলেস ইত্যাদি ডিভাইস অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আর সেগুলো শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে যোগাযোগ সৃষ্টি করে। ওয়াইওফাইও ঠিক এভাবেই কাজ করে। ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রথমবার ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন গঠন করে। তখন তিনটি ফ্রিকোয়েন্সি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় সরকার। যে কেউই লাইসেন্স ছাড়া ব্যবহার করতে পারবে 900MHZ, 2.4 Ghz এবং 5.8 Ghz ফ্রিকোয়েন্সিগুলো। প্রাথমিকভাবে এই ফ্রিকোয়েন্সিগুলো বাসা-বাড়িতে বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হতো। তখন সবার মনে ধারণা ছিলো এই ব্যান্ডগুলো হয়তো বিশেষ কোন কাজে লাগবে না। একসময় এই ব্যান্ডগুলো ব্যবহার করার জন্য বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে মার্কিন সরকার। এই তরঙ্গ ব্যবহারকে তখন স্পার্ড স্পেকট্রাম টেকনোলজি হিসেবে নাম দেয়া হয়।
স্পার্ড স্পেকট্রাম প্রযুক্তির প্রথম লাইসেন্স দেয়া হয়েছিলো ১৯৪১ সালে। এই প্রযুক্তির কল্যাণে ঐতিহাসিক ঐ দিনগুলোতে ওয়্যারলেস ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছিলো। এই প্রযু্ক্তির মাধ্যমে একাধিক ফ্রিকোয়েন্সিতে সংকেত পাঠানো যেতো। এছাড়াও এসময় আরও একটি নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছিলো যা WLAN (ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক) হিসেবে পরিচিত ছিলো। তবে WLAN এর নানারকম প্রযুক্তিগত ত্রুটি থাকায় তা বেশিদিন টিকতে পারেনি।
এনসিআর করপোরেশন ১৯৮৮ সালে একটি ওয়্যারলেস বা ওয়াইফাই ক্যাশ রেজিস্ট্রার পরিচালনার জন্য ইন্সটিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স (IEEE) প্রতিষ্ঠা করেন। ভিক্টর হেইস এবং ব্রুস টুচের সহায়তা প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হয় যা বর্তমানে ওয়াফাইয়ের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এই প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক স্ট্যান্ডার্ডকে “802.11” হিসেবে পরিচিত করানো হয়। শুরুর দিকে এই মানদন্ডের ওয়াইফাই ইন্টারনেটের ডাটা ট্রান্সফারের গতি ছিলো সেকেন্ডে ২ মেগাবাইট। তবে দ্বিতীয় ধাপে ১৯৯৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি ওয়াইফাইয়ের আরেকটি সংস্করণ প্রকাশ করেছিলো যার নাম ছিলো 802.11a এবং গতি ছিলো সেকেন্ডে ৫৪ মেগাবাইট। দ্বিতীয় সংস্করণ খুব বেশি কার্যকারী হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় 802.11b নামে আরও আরও একটি সংস্করণ প্রকাশের প্রয়োজন হয়। তৃতীয় সংস্করণটির ব্যয় খুব কম ছিলো এবং পরিসরও ছিলো অনেক বেশি। ইন্সটিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্সের তৃতীয় সংস্করণ থেকে আধুনিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের সূত্রপাত ঘটে।
ওয়াইফাইয়ের এই সংস্করণটি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হার্ডওয়্যারের বাজারজাতও শুরু হয়েছিলো কিছুদিনের মধ্যেই। তবে পরিসর বজায় রাখতে বাণিজ্যিক ওয়াইফাই ডিভাইসের ব্যয় ছিলো অনেক বেশি। সে কারণে ৬টি কোম্পানি একত্রে ওয়্যারলেস ইথারনেট জোট বা WECA গঠন করে যা 802.11b স্ট্যান্ডার্ডের ওয়াইফাই কম্পিটিবিলিটি পরীক্ষা করে কম খরচে ডিভাইস উৎপাদনের উপায় খুঁজে বের করে। ২০০২ ওয়াইফাই এলায়েন্সের মাধ্যমে ওয়াই-ফাই এবং ওয়্যারলেস শব্দ দুটি চালু করা হয়। এ সময় থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ওয়াইফাই ইন্টারনেট।
ওয়াইফাইয়ের খুঁটিনাটি
ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড হ্যাক করার নিয়ম জানতে চান? অন্যের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড হ্যাক করা একেবারেই অন্যায় যা ডিজিটাল চুরির অপর নাম। অনৈতিক এ কাজটি না করাই ভালো। বাজারের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওয়াইফাই রাউটার পাওয়া যায়। একেক ডিভাইসের পাসওয়ার্ড একেক রকম। নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য একটি প্রাথমিক রুট পাসওয়ার্ড ইউজার ম্যানুয়াল কিংবা রাউটারের গায়েই লেখা থাকে। ওয়াইফাই রাউটারের দাম কত? এ বিষয়টি একান্তই কোম্পানীর নিয়মানুযায়ীই হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন রাউটারের ক্ষমতাও ভিন্ন ভিন্ন হয় তার ভিত্তিতে দামের পার্থক্য হয়ে থাকে। বাজারে যেসব রাউটার সহজলভ্য সেগুলোর দাম ৮০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। বাসা বাড়িতে ব্যবহার উপযোগী কোন রাউটারের দাম ৮০০-২০০০ টাকা হলেই যথেষ্ট। অফিস কিংবা বাণিজ্যিক এলাকায় বেশি ব্যবহারকারী এবং বেশি রেঞ্জের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে ভালো রাউটারের দাম দাম ৫-১০ হাজার টাকার মধ্যে হলে ভালো। ক্ষেত্র বিশেষে রাউটারের দাম এর চেয়ে বেশিও হয়ে থাকে। অনেক ব্যবহকারীরা ওয়ােইফাই অনুও ব্যবহার করে থাকেন। তাদের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে ওয়াইফাই অনুর দাম কত? সে কি খুব বেশি? আসলেই নয়। অনুর দাম রাউটারের দামের মতোই। অনুর দামও ১৫০০ থেকে ৫০০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়। জানতে চান ওয়াফাই তারের দাম কত? নতুন ওয়াইফাই সংযোগ নিতে হলে এ বিষেয় জ্ঞান থাকা উচিত। ওয়াইফাইয়ের দুই ধরণের তার বা ক্যাবল হয়ে থাকে। একটি হলো ফাইবার জাতীয় আরেকটি সাধারণ তারের মতো যা বাজারে ক্যাট৫ বা ক্যাট৬ হিসেবে বেশি পরিচিত। আপনি যে ধরণের তার বা ক্যাবল কিনতে চান দাম ৯ টাকা থেকে ১৬ টাকার মধ্যেই পাবেন।