প্রীতিলতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশবিরোধি আন্দোলনে এক অগ্রগামী নারীনেত্রী। তার অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলার অগ্নিকন্যা বলে খ্যাতি আছে। ডাকনাম রানী, ছদ্মনাম ফুলতারা। পিতা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভা দেবী। নিবাস পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম। ব্রিটিশবিরোধি আন্দোলনে তিনি অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রথম বিপ্লবী শহীদ। তিনি ১৯১১ সালের ৫ মে তার পৈতৃক নিবাস পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বংশপদবী ছিলো দাশগুপ্ত। বাবা জগদ্বন্ধু মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানীর দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তাদের কোন পূর্ব পুরুষ নবাবী আমলে ওয়াহেদেদার উপাধি পেয়েছিলেন। তখন থেকেই তাদের দাশগুপ্ত পদবী পরিবর্তন হয়ে ওয়াদ্দেদারে রূপান্তিরত হয়েছিলো।

প্রীতিলতার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। সংসারে প্রীতিলতা ছাড়াও রয়েছে পাঁচ ভাইবোন মধুসূদন, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। পটিয়ায় বাবার চাকরির সুবাদে তারা সর্বশেষ চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে বসবাস করতেন। বাড়িটি টিনের ছাউনি দেয়া মাটির তৈরি একটি দোতলা বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতা ছিলেন অন্তর্মুখী ও লাজুক প্রকৃতির মানুষ। বাড়ির বাইরে খুব বেশি চলাচল না থাকায় সবসময় তার মাকে সংসারের কাজে সহযোগিতা করতো। ১৯১৮ সালে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয় প্রীতিলতার। শৈশবের শিক্ষার পাঠ তিনি এ স্কুলেই শুরু করেছিলেন। স্কুলে আর্টস এবং সাহিত্য ছিলো তার খুবই প্রিয়। তার চেয়েও প্রিয় ছিলেন শিক্ষিকা ঊষাদি। ঊষাদি তাদের বিপ্লবী ইতিহাসের গল্প শোনাত। কল্পনা দত্ত নামে একজন প্রিয় বন্ধুও ছিলো তার।

তারা দুজনেই একসাথে খেলা করতো, পড়াশোনাও করতো। একসাথে স্বপ্নও দেখতো তারা। কল্পনা দত্ত তাদের সপ্ন সম্পর্কে লিখেছেন, কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম। ১৯২৬ সালে তিনি সংস্কৃত কলাপ পরীক্ষায় বৃত্তি অর্জন করেন। ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯২৮ সালে। প্রীতিলতা খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। কয়েকটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলো। ১৯৩০ সালে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ভালো ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পান। ভর্তি হলেন কলকাতার বেথুন কলেজে।

দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন তিনি। অনার্স অধ্যয়নের সময়ই তীব্র আকঙ্খার কারণে যুক্ত হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। সে কারণে শেষ পর্যন্ত আর তার পরীক্ষা দেয়া হলো না। ডিসটিংশান নিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্ত্বের সাথে ১৯৩২ সালে স্নাতক পাশ করলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে প্রীতিলতা ও বীণা দাসগুপ্তের ফলাফল প্রকাশ করেনি সরকার। তবে বহু দিন পর ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রীতিলতাকে মরণোত্তর ড্রিগ্রি প্রদান করে ভারত সরকার।

প্রীতিলতা বিপ্লবী হলেন কিভাবে?

প্রীতিলতা তখন কৈশোরে পা দিলেন। ১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর, নগরীর টাইগার পাস মোড়ে সরকারি কর্মচারিদের বেতনের ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে সূর্য সেনের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরা। এ ঘটনায় রেলওয়ে ডাকাতি মামলায় সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি প্রীতিলতার মনে হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয়। কৌতুহলে ডুবে গেলেন। প্রিয় শিক্ষিকা ঊষাদি তাকে মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানান। তার দেয়া “ঝাঁসীর রাণী” বইটির লক্ষ্মীবাই চরিত্রটি প্রীতিলতার মনে দাগ কাটে। ভেতরে ভেতরে বিপ্লবী হয়ে উঠেন তিনি।

১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স আইন করে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক ও গ্রেপ্তার করছে ব্রিটিশরা। বিপ্লবী যুবকদের যেখানেই পাচ্ছে তাদের সাইকেল, বইপত্র এবং অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতে হতো। পূর্ণেন্দু দুস্তিদার, প্রীতিলতার একজন নিকট-আত্মীয়। তিনি বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের সকল প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করলে পূর্ণেন্দুদা কিছু প্রকাশনা প্রীতিলতার কাছে লুকিয়ে রাখে। প্রীতিলতা অবসরে কিছু বই পড়েন। ফলে তার বিপ্লবী আদর্শের ভিত আরও মজবুত হয়। পূর্ণেন্দুদার কাছে বিপ্লবী দলে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ‍উপায় ছিলো না। তখন বিপ্লবী দলে নারীদের যোগদানের অনুমতি ছিলো না।

ইডেন কলেজে অধ্যয়নকালে কলেজের শিক্ষক নীলিমাদির মাধ্যমে লীলা রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। লীলা রায় বিপ্লবী সংগঠন ‘শ্রীসংঘের’ নারী শাখা ‘দীপালি সংঘের’ দায়িত্বে ছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি তখন ভেতরে ভেতরে নিজেকে সূর্য সেনের সৈনিক মনে করতেন। তিনি লিখেছিলেন, “আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গডে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি”। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে প্রিয় বন্ধু কল্পনা দত্তসহ উপস্থিত থেকে চট্টগ্রাম বিপ্লবী শাখায় যোগদানের ইচ্ছপ্রকাশ করেছিলো। তাতে কোন ফল না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে আবারও ঢাকায় ফিরলো।

পূর্ণেন্দু দস্তিদার যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তো। প্রীতিলতা সবেমাত্র কলকাতার বেথুন কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। একই শহরে থাকার সুবাদে প্রায়ই পূর্ণেন্দুদার সাথে দেখা হতো তার। পূর্ণেন্দুদা থাকতেন মধ্য কলকাতার আরেক বিপ্লবী নেতা মনোরঞ্জন রায়ের পিসির (গুনু পিসি) বাড়িতে। মনোরঞ্জনকে সবাই ক্যাবলাদা হিসেবেই চিনে। তিনি নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ করতেন এবং আত্মগোপনে থাকা নেতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। পূর্ণেন্দুদার সাথে দেখা করতে আসার সুবাদে গুনু পিসির বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিলো প্রীতিলতার এবং এভাবেই ধীরে ধীরে বিপ্লবী কাজে সক্রিয় হতে থাকে। । এ বাসায় বসেই প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, রেণুকা রায়, কমলা চ্যাটার্জী প্রমুখ বহু গোপন বৈঠক করেন। তারা মাস্টারদার পাঠানো ইশতেহার সাইক্লোস্টাইলে ছাপিয়ে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করতেন। প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তের এমন সাহস দেখে মনোরঞ্জন রায়ের আত্মবিশ্বস হয় তাদের বিপ্লবী কাজে লাগানো যাবে।

১৯৩০ সালে বাংলার নবনিযুক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ টিজে ক্রেগকে মারার জন্য মাস্টারদা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্দেশ দেন। ক্রেগ চাঁদপুর সফরে থাকায় তারা চাঁদপুর রেল স্টেশনে পৌঁছায় তবে ভুল করে ক্রেগকে হত্যা না করে চাঁদপুরের এসডিওকে হত্যা করেন। রামকৃষ্ণ ও কালীপদ তখন পুলিশের হাতে রিভলবার ও বোমাসহ ধরা পড়েন। বিচারের রায়ে রামকৃষ্ণকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আলিপুর জেলে এবং কালীপদকে নির্বাসন দণ্ড দেয়া হয়। চট্টগ্রাম থেকে আলীপুর জেলে গিয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কারো দেখা করা সম্ভব ছিলো না। তাই রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে প্রীতিলতাকে চিঠি লেখেন মনোরঞ্জন রায়। হিজলীর জেলে মনোরঞ্জনের মা তার সাথে দেখা করতে গেলে চিঠিটি তার হাতে দিয়ে প্রীতিলতাকে পৌঁছে দিতে বলে। পরে গুনু পিসির পরামর্শে প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করার জন্য ‘অমিত দাস’ ছদ্ম নামে আলীপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে রামকৃষ্ণের কাজিন পরিচয়ে আবেদন করে। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে প্রায় ৪০ বার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন প্রীতিলতা। সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি এক লিখিত বর্ণনায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেছিলেন।

তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদীমন এবং প্রগাঢ় উপলব্দিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।

মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে পরিচয়

মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে দেখা করার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৩১ সালে বি এ পরীক্ষা শেষ করে তিনি চট্টগ্রাম ফেরেন। তখন তার বাবার অবসরে গেলে পরিবারের হাল ধরেন তিনি। চট্টগ্রামের নন্দকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করলেন। ১৯৩১ সালেই সাংগঠনিক কাজে সূর্য সেনের টাকার দরকার ছিলো। বাবার মাসিক বেতনের পুরোটাই সংসারের খরচের জন্য তুলে দিতেন প্রীতিলতার হাতে। প্রীতিলতা সে টাকা সংগঠনের জন্য তুলে দিলে চােইলে ঘোর আপত্তি জানায় কল্পনা দত্ত।

প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারণে এক সন্ধ্যায় কল্পনা দত্ত নির্মল সেনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। নির্মল সেন মাষ্টারদা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সব পরিকল্পনায় সূর্য সেনের সাথে নির্মল ছিলেন। নির্মল সেনের অনুরোধে সূর্য সেন প্রীতিলতার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। মে মাসের শেষের দিকে তিনি প্রীতিলতাকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করেন। প্রীতিলতার সাথে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাষ্টারদা লিখেছেন

তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম…

সেদিন সাক্ষাতের আগে কল্পনা দত্তের কাছ থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কে বিস্তর তথ্য জেনেছেন সূর্য সেন। সাক্ষাতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস সম্পর্কে দুই ঘণ্টা কথা বললেন প্রীতিলতা। রামকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাত করায় সূর্য সেন খুব খুশি হয়েছেন এবং তা প্রকাশও করেন। ১৯৩২ সালে অনেক পরিকল্পনা করেও কোন ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি সূর্য সেনরা। সব পরিকল্পনাই সূর্য সেন ও নির্মল সেনের। এ সময় তারা গ্রাম থেকে গ্রামে আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থলে ঘুরে বেড়াতেন। ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। সাবিত্রী দেবীকে সবাই ‘সাবিত্রী মাসিমা’ বলে সম্বোধন করে। এই বাড়িটির নাম ‘আশ্রম’। সূর্য সেন এবং নির্মল সেন এই বাড়িতে বসেই অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং যে কোন পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নিতেন। ১৯৩২ সালের ১২ জুন। তুমুল ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যা। মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে লোক পাঠিয়ে ‘আশ্রমে’ নিয়ে আসেন। প্রীতিলতা বাড়ি থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়ার কথা বলে বের হয়েছিলেন। তখন সেখানে মাষ্টারদা, নির্মল সেন ছাড়াও ছিলেন অপূর্ব সেন (ভোলা)। ভোলা ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক একে তরুণ বিপ্লবী।

মে মাসে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দিয়েছিলো, মাষ্টারদা সূর্য সেন এবং নির্মল সেনকে কেউ মৃত অথবা জীবিত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০০০০ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। ১৩ জুন রাত। সাবিত্রী দেবীর বাড়ির রান্নাঘরে প্রীতিলতা এবং সূর্যে সেন খাবার খাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পর ইন্সপেক্টর তার দলবল নিয়ে ‘আশ্রমে’ আসেন। মাষ্টারদার সাথে খেতে বসে অস্বস্থিবোধ করায় প্রীতিলতা উপরের ঘরে চলে যায়। তার লজ্জাবোধ অবাক করেছিলো নির্মল সেনকে। ততক্ষণে ঘর ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। ভেতরের মই বেয়ে মাষ্টারদা উপরে পুলিশ আসার খবর পৌঁছে দেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস জোরপূর্বক ঘরে ঢুকে সাবিত্রী দেবীকে দেখতে পান। তার ছেলে মেয়েও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করেন আরও কেউ ঘরে আছে কিনা। সাবিত্রী মাসীদের নীরবতায় পুলিশ বিরক্ত উপরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাইরের সিঁড়ি ইন্সপেক্টর এবং সাব-ইন্সপেক্টর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজায় নক করলেন। দরজা খুলেই নির্মল সেন ইন্সপেক্টরের উপর গুলি চালান। নির্মল সেনের দুটো গুলিতে সাথে সাথেই মৃত্যু হয় ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের। নির্মল সেনের গুলির জবাবে ঘিরে থাকা সিপাহীরা অনর্গল গুলি চালালে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নির্মল সেন।

টাকা পয়সা, দলীয় নথি ও অন্যান্য কাগজপত্র গুছিয়ে মাষ্টারদা সূর্য সেন প্রীতিলতা এবং অপূর্ব সেনকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পথে শুকনো পাতায় পায়ের আওয়াজ পেয়ে গুলি চালায় সিপাহীরা। ফলে সামনে থাকা অপূর্ব সেন পুলিশের গুলিতে মারা যান। সেই রাতে মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতা কচুরিপানার পুকুর এবং কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী কাশীয়াইশ গ্রামের অন্য এক বিপ্লবী মনিলাল দত্তের বাড়ি পৌঁছান। মনিলাল দত্ত এ বাড়ির লজিং মাষ্টার। কচুরিপানার পুকুরে প্রীতিলতার সংগ্রহ করা রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাক্ষাৎকারের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে। মনিলাল দত্তের বাড়িও নিরাপদ নয় বলে তাদের অন্য কোন আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বলেন সূর্য সেন।

মনিলাল ভেবে চিন্তে তাদের ধলঘাট থেকে ৬ কিলোমিটার দূরত্বে জৈষ্ঠ্যপুরা গ্রামে নিয়ে যান। জায়গাটি ছিলো পাহাড়, জঙ্গল আর নদী ঘেরা। পুলিশ আসলে জঙ্গল কিংবা পাহাড়ে পালানো যাবে। বেশি সমস্যা মনে হলে নদী পার হয়ে অন্য আশ্রয়ে যেতে পারবেন ভেবেই এই গ্রামের কথা ঠিক করা হয়। জৈষ্ঠ্যপুরার গোপন আস্তানাটির নাম ছিলো ‘কুটির’। কুটিরে আত্মগোপনে ছিলেন সুশীল দে, কালীকিংকর দে এবং মহেন্দ্র চৌধুরী। সেখান থেকে প্রীতিলতাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। প্রীতিলতার বাড়িতে পুলিশ নজরদারি ছিলো না। মনিলাল শহরে ঘুরে এ খবর নিশ্চিত করেছিলেন। বাড়ি ফিরে প্রীতিলতা নিজের চাকরিতে যোগদান করেন। ‘চট্টগ্রামে সৈন্য ও বিপ্লবীদের সংঘর্ষ’ শিরোনামে এই খবরটি ১৫ জুন ১৩৯২ সালে কলকাতার দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিলো।

এইমাত্র সংবাদ আসিয়াছে যে, গতরাত্রে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার নিকটে বিপ্লবী ও সৈন্যদের এক সংঘর্ষ হইয়া গিয়াছে। ফলে গুর্খা বাহিনীর ক্যাপ্টেন ক্যামেরন ও দুইজন বিপ্লবী নিহত হইয়াছেন। বিপ্লবীদের নিকট দুইটি রিভলবার ও গুলি ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে। নিহত বিপ্লবীদের একজনকে নির্মল সেন বলিয়া শনাক্ত করা হইয়াছে।

 

প্রীতিলতার আত্মগোপন ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড

ধলঘাটে সাবিত্রী মাসির বাড়িতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের মৃত্যুর পর সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন খবর পাঠিয়ে পটিয়ার মিলিটারি ক্যাম্প থেকে আরও ৩০ জন সৈন্য নিয়ে আসেন। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ বাহিনী পুরো বাড়িতে গুলিতে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। পরদিন সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সেনাধ্যক্ষ মেজর গর্ডন সদলবলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসেন। বিপ্লবীদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে সাবিত্রী দেবীকে ছেলে মেয়েসহ গ্রেপ্তার করেন। পরে তাদের চার বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পুলিশ তল্লাশী চালিয়ে ঘর থেকে উদ্ধার করে রিভলবার, কিছু ছবি ও পাণ্ডুলিপি। উদ্ধার হওয়া ছবির ব্যক্তিদর মধ্যে একজন ছিলেন প্রীতিলতা।

২২ জুন সাব-ই্সপেক্টর শৈলেন্দ্র সেনগুপ্তের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল আবারও মাসিমার বাড়িতে তল্লাশী চালায়। উদ্ধারকৃত নথিপত্র থেকে জানা যায় প্রীতিলতা আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ফাঁসির আসামী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথ দেখা করতো। প্রীতিলতার হাতের লেখা মিলিয়ে তা প্রমাণ করে পুলিশ। দ্বিতীয়বার তল্লাশীর পর প্রীতিলতাকে আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দেন মাষ্টারদা সূর্য সেন। ৫ জুলাই ১৯৩২ মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে করে আত্মগোপন করেন। ছাত্রী পড়ানোর নাম করে বাড়ি ছেড়েছিলেন প্রীতিলতা। দিন শেষেও ফিরে না আসায় তার বাবা অনে খোঁজ খবর নিয়েও তার সন্ধান করতে পারেনি। পরে তিনি থানায় খবর দিলে পুলিশ তৎপর হয়। চট্টগ্রাম শহরের গোপন আস্তানায় কিছুদিন কাটানোর পর পড়ৈকড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেন প্রীতিলতা। বিপ্লবীদের এই গোপন আস্তানাটির নাম ছিলো ‘কুন্তলা’। সেখানে তখন অবস্থান করছিলেন মাষ্টারদা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদার।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাব। সে দিন ছিলো ‘গুড ফ্রাইডে’ তাই পরিকল্পনা সফল হয়নি। শহরের উত্তরে পাহাড়তলী স্টেশনের নিকটবর্তী এই ক্লাবটি ছিলো ব্রিটিশদের প্রমোদ কেন্দ্র। চারদিকে ছিলো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী। গেটে সাইনবোর্ডে লেখা ছিলো ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।

এর মধ্যে ক্লাবের একজন বেয়রা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে আশ্রয় পেলেন বিপ্লবীরা।অনেক দিন পর ১৯৩২ সালের ১০ আগস্ট আবারও নতুন পরিকল্পনা করা হয় ক্লাব আক্রমণের। সেদিন শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ৭ জনের একটি দল আক্রমণে যায়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তী আগে থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আক্রমণ শেষ হওয়ার পর যদিও নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার সুযোগ থাকে তবুও আত্মহত্যা করবে। তারা আক্রমণে ব্যর্থ হলো এবং তাদের ফিরে যেতে হলো কিন্তু ফিরলো না শৈলেশ্বর। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। পরে গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্র সৈকতে তাকে সমাহিত করা হয়।

বার বার ব্যর্থ হওয়া ক্লাব অপারেশন নিয়ে উদ্বিগ্ন মাষ্টারদা। শেষে তিনি পরিকল্পনা করলেন এবার ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেবেন নারী বিপ্লবীদের। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নতুন দিন ধার্য করা হয়। এই পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিলো কল্পনা দত্তের কিন্তু সাতদিন আগেই পুরুষ ছদ্মবেশে পুলিশের হাতে কল্পনা ধরা পড়ায় তা হলো না। শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্বভার পড়লো প্রীতিলতার উপর।

প্রীতিলতার নেতৃত্বে সেদিনের অপারেশনে সঙ্গী ছিলেন কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী, মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন। প্রত্যেকেরই ছিলো ভিন্ন ছিন্ন ছদ্মবেশ। ক্লাবের পাশেই ছিলো পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এই এলাকা দিয়েই যেতে হবে বলে ছদ্মবেশও ছিলো সেরকমই। প্রীতিলতার পরনে ছিলো মালকোঁচা দেয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী। চুল ঢেকেছিলেন সাদা পাগড়ি দিয়ে, পায়ে ছিলো রাবার সোলের জুতা। তিনি পাঞ্জাবী ছেলেদের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন।

এই অপারেশনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন ক্লাবেরই একজন বেয়ারা এবং বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার। সেদিন ছিলো শনিবার। রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিটে যোগেশ ইশারা দিতেই হুঁইসেল বাজিয়ে সঙ্গীদের আক্রমণের নির্দেশ দিলেন প্রীতি। ক্লাবে প্রায় ৪০ জন মানুষ। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলো তারা। বিপ্লবীদর মুহূর্মুহূ গুলিতে কেঁপে উঠেছিলো পুরো ক্লাব, নিভে গিয়েছিলো ক্লাবের সব আলো। অন্ধকারে সবাই এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। ভেতরে থাকা দুয়েকজন পুলিশ ও মিলিটারি অফিসারের সাথে থাকা রিভলবার দিয়ে তারাও শুরু করে পাল্টা আক্রমণ। মিলিটারি অফিসারের ছোড়া গুলিতে আঘাত লাগে প্রীতিলতার বাঁম পাশে। এক পর্যায়ে আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। ফিরে আসছিলেন সঙ্গীদের নিয়ে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী সেদিন ক্লাবে আক্রমণের ফলে মিসেস সুলিভান নামে একজনের মৃত্যু হয় এবং ৪ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী গুরুতর জখম হন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?

অপরাশেন শেষ করে সঙ্গীদের নিয়ে ফেরার সময় প্রীতিলতা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন। তার অস্ত্র কালীকিংকরদের কাছে জমা দেয়ার সময় আরও পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলেন। কালীকিংকরদে প্রীতিলতার মুখে ঢেলে দিলেন। তিনি সঙ্গীদের নির্দেশ দিলেন দ্রুত স্থান ত্যাগ করার জন্য। শেষে প্রীতিকে বিপ্লবী শ্রদ্ধ জানিয়ে সবাই চলে গেলেন। সকালে পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে তার মরদেহ উদ্ধার করে এবং তাকে শনাক্ত করে। তদন্তে জানা গেছে তার গায়ে লাগা গুলির আঘাত খুব গুরুতর ছিলো না। পটাশিয়াম সায়ানাইডের কারণেই প্রীতিলতার মৃত্যু হয়েছিলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *