কিশোর গ্যাং দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপরাধীদের লাগামহীন দৌরাত্ম্য, আইনের সু-শাসনের অভাব এবং অভিভাবকদের গাফিলতির জন্য আমাদের কিশোর সমাজের আজ এমন পরিণতি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যে যেরকমই মনে করুক না কেন বেপরোয়া কিশোর গ্যাং থামাতে না পারলে তারা ভুক্তভোগী হবেন যারা অবহেলা করছেন।
প্রথম দিকে কিশোর গ্যাং শুধু শহর কিংবা নগরীতেই দেখা যেতো। আজ জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যােয়ে তাদের দেখা মেলে। আগের কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড এবং দ্রুত বিচার না হওয়ায় দিন দিন নতুন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আরও বেশি উৎসাহ পাচ্ছে। উঠতি বয়সী কিশোরদের কাছে আইনের দুর্বলতাই তাদের বেপরোয়া হওয়ার অনেক বড় কারণ।
নগরকেন্দ্রিক এ সমস্যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক সর্বত্রই বিরাজ করছে। তুচ্ছ বিরোধ কিংবা সমস্যাকে কেন্দ্র করে তারা বড় বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাতেই ৭৮ কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে যাদের সদস্য সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি। তাদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবহার করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যরা তাদের ছায়ায় বেড়ে উঠছে এবং বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের কাছে রয়েছে অনেক রকমের অস্ত্র। আধিপত্য বিস্তার তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও ছোটখাট ঘটনা তো প্রতিদিন লেগেই আছে।
পাসের প্রতিযোগিতায় মত্ত আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কত জিপিএ ৫ পেলো, পাসের হার কত? ইত্যাদি নানা প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধের শিক্ষা। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস, সর্বাধিক নম্বরের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠদান করে থাকে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক আচরণও যে শিক্ষার অংশ তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কারিকুলাম কিংবা শিক্ষকদের মাথায় একেবারেই নেই। কিশোরদের নৈতিক শিক্ষার অভাবে অন্যায়, অপরাধ তাদের কাছে ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন কিশোরদের পড়ার টেবিলে থাকার কথা তখন তাদের দেখা মেলে পাড়ার ক্লাব, খেলার মাঠ কিংবা হাট-বাজারে। তাদের পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দিলে হয়তো কিশোর গ্যাং কমতে পারে।
প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার ও প্রয়োগ আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করে তুলেছে। আমরা প্রযুক্তির অনেক সুবিধা ব্যবহার করছি। প্রযুক্তি ব্যবহারে বয়সের কোন বিধি বিধান মানা হয় না বলেই শিশু-কিশোররা অবাধে ব্যবহার করছে প্রযুক্তি। ইন্টারনেট প্রযুক্তির সুবাদে বিভিন্ন বিপথগামী হচ্ছে কিশোর তরুণরা। তাদের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই। এখান থেকে বলতে গেলে তারা প্রশিক্ষিত হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এছাড়া পর্ণোগ্রাফি নিয়ে অনেক আগেই তোলপাড় হয়েছে সারাদেশে। পর্ণোগ্রাফির মূল উৎসও ইন্টারনেট।
চট্টগ্রামের মহানগরীতে ছিনতাই, হত্যা, ফুটপাতে হকার বসানোসহ আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকাভুক্ত ২৫২ কিশোর। তারা সবাই ৪৮ জন রাজনৈতিক নেতা ও সন্ত্রাসীর ছত্রছায়ায় আশ্রিত।
বরগুনার রিফাত হত্যার মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হুঙ্কার সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। নৃশংস এ খুনের ঘটনায় সারাদেশ কেঁপেছিলো। এ ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। যে বয়সে কিশোরদের বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা তখন তারা ছুরি, লাঠি এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরছে যত্রতত্র। পুুঁজিবাদের এ সময় অর্থের নেশায় মাতাল অভিভাবকদের কারণেই এসকল কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কিশোর গ্যাং শক্তিশালী হয়ে উঠার পেছনে পরিবার অনেকাংশেই দায়ী।
বাবা-মা কাজের জন্য বাইরে থাকলে কিশোরদের সঙ্গ দেয়ার কেউ থাকে না। হয়তো ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, গেমসই তাদের একমাত্রা অনুষঙ্গ। তাদের অনেকেরই সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হলো অন্য কিশোররা। বাবা মায়ের দৃষ্টির আড়ালে তার কিশোর সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে তা দেখার সময়ও তাদের নেই। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে শুধু জানতে পারে ছেলে বন্ধুর সাথে সময় কাটিয়েছে। বন্ধু কে, কেমন বন্ধু তা দেখা বা জানার কোন আবশ্যকতা নেই। বাসায় ফিরেই বাবা মায়েরা রান্না, টিভি দেখা নয়তো চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া ছাড়া আর কোন কিছুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। সহজ কথায় বললে অসচেতন অভিভাবকরা যেন তার সন্তানকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবেই প্রস্তুত করছেন।
কিশোর গ্যাং বাড়ছে। এর দায় সরকার, সমাজ এবং পরিবার কেউই এড়াতে পারবে না। আমরা আমাদের সমাজে কিশোরদের অন্যায় অপরাধ করতে দেখেও তাদের বাধা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। অপরাধী কিশোরদের সংশোধনের দায়িত্ব সরকারের থাকলেও বেশিরভাগ থানায় নেই কিশোর অপরাধীদের জন্য আলাদা সেল এবং দায়িত্বরত কোন কর্মকর্তা। খবরের কাগজে আমরা শুধু কিশোর অপরাধের গল্পই শুনে থাকি। কখনো কিশোর সংশোধন হয়ে ফিরে এসেছে এমন গল্প দেখা যায় না। তাই সচেতন নাগরিক, দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিশোর গ্যাং দমনে এগিয়ে আসার সময় এখন।