আফগান যুদ্ধ ও দখলের ইতিবৃত্ত

আফগান যুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা। পশ্চিমা পরাশক্তির কাছে মাথানত করা এক অসহায় জাতি আফগান। গত দুই দশকের ইতিহাসে ঐতিহ্যের জৌলুস অনেকটাই হারিয়েছে মুসলিম বিশ্বের এই দেশটি। ইতিহাস সত্য, ইতিহাস বারবার ফিরে আসে। ইতিহাসে আফগানিস্তানের গুরুত্ব ছিলো বিশ্বজুড়ে। বহু বছরের যুদ্ধ-বিগ্রহ বিধ্বস্ত করেছে আফগানিস্তানের ভাবমূর্তি এবং জীবন ব্যবস্থা। সম্প্রতি তালেবানদের হুঙ্কারে মার্কিনীরা পরাজয় মেনে নিলেও আফগানিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ হতে অনেক সময় বাকি। আফগানিস্তানের ভাগ্য কেন এত খারাপ জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পেছনে।

আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার উত্তাপ ছড়িয়েছিলো সারা বিশ্বে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের এ ঘটনায় থমথমে হয়ে গিয়েছিলো সরা দুনিয়া। টুইন টাওয়ারে হামলাকারী আফগানিস্তানে আত্মগোপন করেছে দাবি তুলে মার্কিন বুশ প্রশাসনের আগ্রাসন ও পরে আফগান যুদ্ধ এবং দখলের গল্প জানার বাকি নেই কেউ। তখনই মার্কিনীদের পরিকল্পনা বুঝা না গেলেও দেশে দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এবং আফগানিস্তানের মাটিতে পরাজয় আজ অনেক কিছুই পরিস্কার বর্ণনা করে। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে জন্য মার্কিন সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছিলো। ৭ অক্টোবর অভিযান শুরু করে দুই মাসের মধ্যে দখলে নেয় দেশটি।

১৯৭৯ সালে ১ লাখ ১৫ হাজার সৈন্য নিয়ে রাশিয়া আফগানিস্তান আক্রমণ করলে তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র তাতে সুযোগ নেয়। রুশদের ‘নাস্তিক্যবাদী’ আখ্যা দিয়ে আফগানিস্তানের গোত্র-উপগোত্রকে ধর্মীয়ভাবে উস্কে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা আফগানদের ‘মুজাহিদ’ (প্রতিবাদী দল) বাহিনী গঠনে উদ্বুদ্ধ করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে সহযোগিতা। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যুবকদের নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে আহ্বান জানায়। এখানেই অবতারণা হয় আফগান যুদ্ধ ও মার্কিন ষড়যন্ত্রের। যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করতে আরব থেকে সৌদি যুবক ও ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনকে নিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবের আর্থিক সহযোগিতা ও পাকিস্তানের আবেগকে উস্কে দিয়ে মুসলিমদের জিহাদ করতে সার্বিক সমন্বয় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১০ বছর যুদ্ধ শেষে আফগানিস্তানে প্রাণ ঝরে ৫ লাখ নিরীহ মানুষের। ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্যও মারা যায় এ যুদ্ধে। আফগান ছাড়তে বাধ্য হলো সোভিয়েত সৈন্যরা। যুদ্ধের জয় আফগানিস্তানেরও নয়, মুসলিমদেরও নয়। জয়ের আনন্দে মতোয়ারা যুক্তরাষ্ট্র।

যুদ্ধ জয়ের পর রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ে শুরু হয় গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব, বিবাদ আর সংঘর্ষ। এ সময় পশতুন ছাত্ররা মিলে তাদের প্রিয় শিক্ষক মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে ভেঙ্গে পড়া আফগানিস্তানকে গুছিয়ে নিতে মাঠে নামে। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য তারা দিন দিন জনপ্রিয় উঠায় গঠন করে সশস্ত্র বাহিনী ‘তালেবান’। এ সময় তেল বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও ইরান-রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখতে তালেবানদের ব্যবহার করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় মার্কিন সরকার। তবে বিপত্তি বাধে ইরাক যুদ্ধের সময়। ইরাক আক্রমণ করার জন্য সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতির প্রতিবাদে মার্কিন ও সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হুঙ্কার ছাড়েন ওসামা বিন লাদেন। লাদেনের এমন আচরণে তালেবানের সাথে মার্কিনীদের মধুর সম্পর্কে ভাঙন ধরে।

২০০১ সাল। অনেক কাঠ-খড় পুঁড়িয়ে সদ্য ক্ষমতার আসীন হওয়া নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। এ বছরেই ১১ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত হামলায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় আমেরিকার টুইন টাওয়ার। নিজের পিঠ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে বুশ। তাই নিকট অতীতের ঘটনার জের ধরে টুইন টাওয়ার হামলার দায় চাপানের ঘৃণ্য অপচেষ্টা করে ওসামা বিন লাদেনের ওপর। সে সূত্রে লাদেনের আশ্রয়দাতা তালেবানরাও হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের চরম শত্রু। লাদেন বারবার এ দায় অস্বীকার করলেও একতরফাভাবে দোষারূপ করতে করতে আগ্রাসী হয়ে উঠে বুশ প্রশাসন। এ সময় টুইন টাওয়ার হামলাকারী শনাক্ত না হলে হয়তো গণরোষে চেয়ার হারাতে হতো সদ্য বিজয়ী প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে। তাই লাদেনকে হস্তান্তরের জন্য বারবার চাপ প্রয়োগ করছিলো তালেবানদের। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়া লাদেনকে হস্তান্তর করতে রাজি না হওয়ায় তালেবান হয়ে উঠে মার্কিনীদের চরম শত্রু। শুরু হয় নতুন চক্রান্ত।

লাদেনকে ফিরিয়ে না দেয়া তালেবনের সাথেও মর্কিনীদের সম্পর্কে টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তেল বাণিজ্যের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসে। আফগান যুদ্ধ ও দখলের পরিকল্পনায় ঘুম হারাম হয় বুশ প্রশাসনের। আফগানিস্তানে তালেবানের বিপক্ষ শক্তির আশ্রয় খুঁজে ডব্লিউ বুশ। তবে আফগানিস্তানের ভাগ্যের আকাশে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। ৯/১১ এক সমন্বিত আত্মঘাতী বোমা হামলায় তছনছ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। ভয়ঙ্কর এ হামলায় ২,৯৯৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহত হয়েছে অন্তত ৬,০০০ এর বেশি মানুষ। ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবকাঠামো ও স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। আল কায়েদা এ হামলার দায় স্বীকার করলেও বুশ একতরফাভাবে লাদেনকেই দায়ী করে। আফগানিস্তান ধ্বংসের হুমকি দেয় বুশ। আফগান যুদ্ধ ও দখলের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

আকাশ ও স্থলপথে বিমান হামলার মাধ্যমে আফগানিস্তানে শুরু হয় মার্কিন আগ্রাসন। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর তালেবানের মরণযুদ্ধে পরাজয়ন মেনে নিতে বাধ্য হয় মার্কিন বাহিনী। শেষে মুক্ত হলো আফগানিস্তান, সমাপ্ত হলো আফগান যুদ্ধ। বর্তমানে দেশটির ক্ষমতার মসনদে আসীন তালেবান সরকার। তবে এখনো রুপরেখা তৈরি হয়নি আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের।

 

তথ্যসূত্র:

দৈনিক নয়া দিগন্ত

উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *