বায়ু দূষণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে

বায়ু দূষণে বাংলাদেশের অবস্থান বলার মতো নয়। বরাবরই শীর্ষ অবস্থনে মাথা উচিয়ে নিচু করছে দেশের মান, সম্মান। অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি আমরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে। বিশ্বের ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাতাসের মান সবচেয়ে খারাপ তিন দেশের, ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। দু:খজনক সতক্য হলো শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

এই দুষণ কমাতে বিশ্বের অনেক সংস্থা অনেক পরামর্শ দিয়ে আসলেও বাস্তবে তা কতটুকু ফলদায়ক হচ্ছে? আসলেই হচ্ছে কি? উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতি দিন দিন আমাদের নানামুখী সমস্যার সামনে দাড় করাচ্ছে। দুষণে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকবে এটি ব্যতিক্রম কিছু নয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো আমরা আমাদের প্রজন্মের যে ক্ষতি করছি তা অপূরণীয়। আগামীর বাংলাদেশের ভোগান্তির শেষ থাকবে না দূষণে বেড়ে উঠা প্রজন্মকে নিয়ে।

বায়ু দূষণে বাংলাদেশ কেন এগিয়ে?

বায়ু দূষণে বাংলাদেশ নানা কারণেই এগিয়ে আছে। আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যাই দূষণের অন্যতম কারণ। ঘনবসতির এ দেশে অপ্রতুল রাস্তাঘাট, বছরজুড়ে আবার সেগুলোর সংস্কার, মিল কারখানা, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণেই প্রতি মুহূর্তে দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশের বাতাস।

ইটভাটা ও শিল্পকারখানা

উদ্বেগজনক দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইটভাটা ও শিল্পকারখানা। ইটভাটা নেই দেশে এমন কোন উপজেলা নেই। প্রায় প্রতিটি উপজেলায় অন্তত ডজনখানেক ইটভাটা রয়েছে যেগুলো প্রতিনিয়ত কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ভারি করছে বাতাস। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ৮ হাজার ৩৩টি। এগুলোর ২ হাজার ৫১৩টিরই নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র।

ইটভাটায় জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণের যে শর্ত রয়েছে তা মানছে না ২ হাজার ৮৩৭টি ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের হিসেবে দেশের প্রায় ৩ হাজারের বেশি  অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে দেশের প্রধান ১২টি শহরেই রয়েছে ১ হাজার ২৪৬টি অবৈধ ইটভাটা। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের ৫ জেলায় রয়েছে প্রায় ৫৫৯টি ভাটা। অপরদিকে দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে বায়ু দূষণে ৫৮% দায়ী এই ইটভাটাগুলো।

কয়লা ইট প্রস্তুতের প্রধান জ্বালানি। এছাড়া বনভূমি উজার করে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ। ইউএনডিপিএর এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে ১ লাখ ইট প্রস্তুত করতে প্রায় ২৩টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে থাকে। একই পরিমাণ ইট প্রস্তুতে চীন সর্বোচ্চ ৮টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে থাকে।  

ইটভাটায় পোড়ানো অতিরিক্ত কয়লা থেকে প্রতিনিয়তই নির্গত হচ্ছে ধুলিকণা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ। এগুলো বাতাসের সংস্পর্শে আমাদের চোখ, ফুসফুস এবং শ্বাসনালীকে দিনকে দিন ধ্বংস করে দিচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত এসব ভাটা থেকে বছরে প্রায় ৮.৭৫ মিলিয়ন টন কার্বন নির্গত হয়।

রাসায়নিক শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। ব্যাপক শিল্পায়নও পরিবেশ দুষণের অন্যতম একটি কারণ। শিল্পোৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট কঠিন, তরল, বায়ুবীয় অবস্থার

অনেক পদার্থ পরিবেশে দূষক হিসেবে কাজ করে। শিল্পকারখানায় উৎপাদিত দূষক হচ্ছে সে সকল পদার্থ যার উপস্থিতি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। বিশেষ করে বাতাসে মিশে এসব দূষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে বাতাসের গুণগত মানকে। ফলে মানুষ তথা প্রাণিকূলের স্বাভাবিক জীবন যাপন হুমকি হয়ে উঠে। প্রতিটি শিল্প কারখানায় কম বেশি ক্ষতিকারক

সিমেন্ট শিল্প কারখানার কথাই ধরা যাক।

সিমেন্ট শিল্পের দূষক সমূহ

সিমেন্ট তৈরীর প্রতিটি ধাপে দূষক পদার্থ উৎপন্ন হয় যা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। সিমেন্ট শিল্পে উৎপন্ন কিছু উল্লেখযোগ্য দূষকের বর্ণনা দেয়া হলো :

  1. সিমেন্ট তৈরীতে CaCo3 কে তাপ দিয়ে CaO এ পরিণত করা হয় এতে প্রচুর Co2 গ্যাস নির্গত হয় যা বায়ুকে দুষিত করে।
  2. সিমেন্ট কারখানায় ঘুর্নায়মান চুল্লীতে উচ্চ তাপ প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন রকমের জ্বালানী যেমন- কোক, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ ইত্যাদি দহন করা হয়। এ সব জ্বালানি দহনে প্রচুর পরিমাণে Co2, So­2NOx ইত্যাদি বায়ু দূষক গ্যাস উৎপন্ন হয় ফলে বায়ু দূষিত হয়। অধিকন্তু নাইট্রোজেন ও সালফারের অম্লীয় অক্সাইডসমূহ অম্ল-বৃষ্টি সৃষ্টি করে যার প্রভাবে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় ও গাছ-পালা বিনষ্ট হয়।
  3. সিমেন্ট শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের থ্যালিয়াম (TI), ক্যাডমিয়াম (Cd), মারকারী (Hg) প্রভৃতি উদ্বায়ী ভারী ধাতু অপদ্রব্য হিসেবে থাকে। চুল্লীর উচ্চ তাপমাত্রায় এসব বিষাক্ত ধাতুর বাষ্প নির্গত হয়ে বায়ু দূষণ করে।
  4. ক্লিংকারের মধ্যে নিকেল, জিংক, লেড ইত্যাদি ধাতু বিদ্যমান। ক্লিংকারের চূর্ণিত পাউডার থেকে এ সব ধাতু নির্গত হয়ে বায়ু দূষণ করে।
  5. সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে পানি দূষণ করে।
  6. সিমেন্ট কারখানায় সিলিকাযুক্ত প্রচুর পরিমাণ ধুলিকণা সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ও আশে পাশের লোকজনের ফুসফুস আক্রান্ত হয় ও স্বাস্থ্যহানী ঘটে।

নির্মাণকাজ

আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে জিকির উঠেছে এ দেশ মধ্যম আয়েরও দেশ। সে কারণেই হয়তো উন্নয়নে ভাসছে সারা দেশ। বছরে একবার শুরু হলে আর যেন থামতেই চায় না সেই উন্নয়নের কাজ।

শুধু বছরই নয় বছরের পর বছর এভাবেই উন্নয়ন করতে করতে হয়তো আজ আমরা কথিত মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। তবে এই উন্নয়নের মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধুয়ো প্রতিনিয়তই মুত্যুর দিকে ঠেলছে অসহায় নাগরিকদের।

উন্নয়ন বলতেই চোখে ভেসে উঠে কাটা রাস্তা, খুড়াখুড়ি আর বর্ষার জলে ডুবে থাকা গর্তে উবু হয়ে ডুবে যাওয়া রিকশা ভ্যান। অর্থাৎ নির্মাণ এবং সংস্কার কাজ সারা বছরই চলে। চলে নিয়মের মধ্যেই, যখন সংস্কারের দরকার হয় তখনই তবে এই সংস্কার বা নির্মাণে কোন শৃঙ্খলা বা নিয়ম থাকে না।

অনিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকা নির্মাণ কাজ দূষণ বাড়াচ্ছে পরিবেশে। পরিবেশের দুষিত বায়ু আমাদের ফুসফুসে জমে বাড়াচ্ছে কঠিন রোগের বিস্তার। আসলে এভাবেই কি হওযার কথা ছিলো নির্মাণ যা বিষিয়ে তোলবে আমাদের বায়ুমণ্ডলকে?

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে যেন মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দিতে হবে।  একইসাথে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণ সামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুইবার স্প্রে করে পানি ছিটানোরও নির্দেশনা রয়েছে।

এছাড়া, নির্মাণাধীন রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা এবং নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে পরিবহন করার কথাও বলে অধিদপ্তর। বাস্তবে তার বাস্তবায়ন না থাকায় বাংলাদেশে বাড়ছে বায়ু দূষণ। বাংলাদেশও এগিয়ে চলছে বায়ু দূষণকারী দেশগুলোর সবার আগে।

যানবাহন থেকে কিভাবে বায়ু দূষিত হয়?

বাংলাদেশের সড়কে যানবাহন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বিষয় সাধারণভাবেই জানি। গাড়ির ফিটনেস না থাকা, রেজিস্ট্রেশন এবং চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা এসব বিষয় খুবই সাধারণ। এগুলোর কারণে প্রতিনিয়ত সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। একইভাবে যে বিষয়গুলো আমরা দেখি না সেগুলো আমাদের পরিবেশ অর্থাৎ বাতাসকে কিভাবে নষ্ট করছে তা আমরা সহজেই ‍বুঝতে পারি না।

আমরা মনে করি যে গাড়িগুলো কালো ধুয়ো ছাড়ছে সেগুলো হয়তো পরিবেশের ক্ষতি করছে। এখানেই শেষ নয় যেগুলো কালো ধুয়ো ছাড়ছে না সেগুলোও বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। তাহলে যানবাহন থেকে কিভাবে বায়ু দূষিত হয়?

গাড়ির ইঞ্জিনের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও ভালো মানের জ্বালানি ব্যবহার না করার কারণে যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া আমাদের চারপাশের বাতাসকে দূষিত করছে। ধোঁয়ার কারণে যতটা বেশি বাতাস দূষিত হচ্ছে তার চেয়ে বেশি দুষিত হচ্ছে ধোঁয়ার সাথে নির্গত হওয়া দূষিত বস্তুকণার জন্য।

যেসব যানবাহন জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করছে সেগুলো থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, জৈব বিষ-পলিনিউক্লিয়ার অ্যারোমেটিক্সের মতো বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হচ্ছে। অপরদিকে পেট্রোল, অকটেন ও সিএনজিচালিত যানবাহন থেকে নিঃসরিত দূষণকারী পদার্থের মধ্যে রয়েছে- আইডল কার্বন মনোক্সাইড ও আইডল হাইড্রোকার্বন।

এসব বস্তুকণার কারণে মানবদেহে ক্যানসার, হৃদরোগ, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের অকার্যকারিতা ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিম্নমানের জ্বালানিতে সালফারের মাত্রা বেশি থাকায় এসব বিষাক্ত বস্তুকণা বেশি নির্গত হচ্ছে এবং বাতাসে মিশে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। তবে ভালো মানের জ্বলানিতে এই নি:সরণের মাত্রা তুলনামূলক কম।

স্বাভাবিকভাবে এই নি:সরণের মাত্রা কমাতে গাড়ির গতি থাকতে হবে নূন্যতম ৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। বাংলাদেশে এমন রাস্তা আছে কোথায়? শহরে তো একেবারেই চিন্তা করা যাবে না। বায়ু দূষণ থেকেও বাঁচা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *