ব্যাম্বু চিকেন পাহাড়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার। আদি যুগে যখন মাটির হাড়ি পাতিলও সহজলভ্য ছিলো না তখন একমাত্র বাঁশই ছিলো পাহাড়ি আদিবাসীদের রান্নার পাত্র হিসেবে ভরসা।
বিকল্প না থাকায় আদিবাসীরা বাঁশের ভেতর রান্না করলেও আধুনিক কালে শহরের দামি দামি রেস্তোরায় জায়গা করে নিয়েছে ব্যাম্বু চিকেন।
যা যা থাকছে
সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাম্বু চিকেন। চিকেন ছাড়াও বাঁশের ভেতর প্রায় সব রকম রান্না করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা আদিবাসীরা বাঁশের চোঙায় রান্নার পদ্ধতিকে বলে ‘চুমো গোরাং’।
শুধু চাকমারাই নয় পাহাড়ের সব আদিবাসীরাই এক সময় বাঁশের চোঙায় রান্না করতো। গোত্রভেদে এ পদ্ধতির রান্নার নামও আলাদা আলাদা। মারমারা বলে থাকেন ‘ক্যাংদং হাং’ এবং ত্রিপুরারা বলেন ‘ওয়াসুং গ প্রেংনাই’।

সাধারণ বাঙালিদের কাছে এ রান্নার কোন নাম নেই। সাধারণের মাঝে এ রান্না প্রচলিত ছিলো না বলে তার নির্দিষ্ট নাম নেই তবে নিত্যদিনের খাদ্য হিসেবে চিকেন বা মাছ আমরা রান্না করেই থাকি। তবে কিভাবে বাঁশের ভেতর রান্না করতে হয়? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর রয়েছে পাহাড়িদের কাছেই।
বর্তমানে ক্যাটারিংয়ের ব্যবসার প্রসারের ফলে পাহাড়েও তা পাওয়া যায় কিংবা অনেক পাহাড়ি সম্প্রদায়ের সামাজিক বড় বড় হাড়ি পাতিলও রয়েছে। তবুও বড় বড় সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে সাদি ইত্যাদি আয়োজনে এখনও অনেকেই ঐতিহ্যবাহী বাঁশের রান্না করে থাকে।
বাঁশে প্রচুর পানি থাকে তাই আগুনে দীর্ঘক্ষণ রান্না করা যায় বাঁশে রান্না করার সময়। প্রায় সব বাঁশের ভেতর রান্না করা গেলেও রান্নার সুবিধার জন্য আগেই উপযুক্ত এবং সুবিধাজনক বাঁশ যোগাড় করতে হয়।
লক্ষ্য রাখতে হবে বাঁশের ভেতরে জায়গা যেন একটু বেশি থাকে। বাঁশের ভেতর রান্না করার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক বাঁশ হলো ফারোয়া বাঁশ, মিটিঙ্গা বাঁশ এবং ডুলু বাঁশ। একটি বাঁশ অনেকবার রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। কারণ প্রতিটি বাঁশ থেকে অনেকগুলো চোঙ পাওয়া যায়।
চিকেন বা মুরগির মাংসের পুষ্টিগুণ
চিকেন বা মুরগির মাংস প্রায় সব মানুষের কাছেই খুব পছন্দের খাবার। আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন উপলক্ষ্য থাকলেই মুরগি রান্না করা হতো। বর্তমানের আয় রোজগার ভালো থাকায় আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
তাছাড়া মাছ ও মাংসের দাম কাছাকাছি কিংবা কোন কোন সময় মাছের চেয়ে সহজলভ্য এবং দামে সস্তায় হওযায় বাজারের তালিকায় মাছের আগে মুরগিই স্থান করে নেয়।
আমরা শুধু খেয়েই চলি কি খাই সে ব্যাপারে আমাদের সচেতনতার অনেক অভাব রয়েছে। ব্যাম্বু চিকেন খেতে সত্যিই সুস্বাদু, কিন্তু আমরা কি জানি চিকেনে কি পরিমাণ ক্যালরি কিংবা পুষ্টিগুণ রয়েছে? চলুন জেনে নিই।
মুরগিতে যেসব পুষ্টিগুণ রয়েছে এবং সেগুলোর উপকারিতা তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
প্রেটিন: মুরগির মাংসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন যা আমাদের পেশীকে অনেক শক্তিশালী করে তোলে। এতে চর্বির পরিমাণ কম তাই নি:সন্দেহে এটি ওজনও কমাতে সহায়ক।
হৃদপিন্ডের নিরাময়: সম্প্রতি স্ট্রোক করে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তাছাড়া ধুমপান ও অ্যালকোহলসেবীদের এ সমস্যার ঝুঁকি অতিমাত্রায়। তবে মুরগির মাংসের অ্যামিনো এসিড হৃদপিন্ডের হোমোকিস্টাইনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে আপনাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পারে। এটি হৃদপিন্ডের এমন এক উপাদান যার উচ্চমাত্রা কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ।
চোখের নিরাময়: চোখ আমাদের শরীরের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চোখ না থাকলে জীবনটাই যেন বৃথা মনে হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে চোখে নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই চোখকে সুরক্ষা দিতে পারে মুরগির মাংসে থাকা রেটিনল, আলফা ও বিটা ক্যারোটিন, লাইকোপেন। এগুলো সবই ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় উপাদান। চোখ ভালো রাখতে ভিটামিন ’এ’ এর গুরুত্ব আমরা সবাই জানি।
পর্যাপ্ত ফসফরাস: দাঁত ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখা আমাদের সুস্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও কিডনি লিভার এবং স্নায়ুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করলে আমরা প্রতি মুহূর্তেই নানা শারীরিক জটিলতায় পড়তে পারি। মুরগির মাংসে প্রচুর ফসফরাস থাকে যা এসব সমস্যার সমাধান করতে পারে খুব সহজেই।
ভিটামিন বি-৬: মানব দেহের জন্য ভিটামিন বি-৬ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ভিটামিন। এটি আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সহায়ক। ব্যাম্বু চিকেনের মুরগির মাংস এ ধরণের ভিটামিনের আদর্শ উৎস।
মস্তিষ্কের চাপ কমায়: মুরগির মাংসে অতি’ মাত্রায় রয়েছে ট্রাইফটোফ্যান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড। এটি এমন এক ধরণের জৈব রাসায়নিক যা নিমিষেই আমাদের বিষণ্নতা দূর করতে পারে। মুরগির পাখনায় খেলে বাড়বে মস্তিষ্কে সেরেটোনিন যা আমাদের চাপমুক্ত রাখবে।
হাড়ের ক্ষয়রোধ: হাড়ের ক্ষয় খুবই সাধারণ সমস্যা। বয়স বাড়ার সাথে বাড়তে থাকে হাড় ক্ষয়ের সম্ভাবনা। তাই প্রতিদিন অল্প করে হলেও মুরগির মাংস খাবার তালিকায় থাকলে হাড় ক্ষয়ে ঝুঁকি কমবে বহুলাংশে।
কিডনি প্রতিরোধ মুরগির মাংস: শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি হলে নানা সমস্যাই দেখা দেয়। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও হতে পারে কোন কোন ভিটামিনের অভাবে। নিয়াসিন এমন একটি ভিটামিন মুরগির মাংসে প্রচুর পরিমাণে থাকে। এছাড়াও ডিএনএজনিত কিছু জটিল সমস্যা ও সমাধান করে থাকে নিয়াসিন।
মুরগির মাংসে কি পরিমাণ ক্যালরি থাকে?
প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসে যে ক্যালরি থাকে তা নিচের তালিকায় উল্লেখ করা হলো:
| উপদান | পরিমাণ |
|---|---|
| পানি | ৭৪ শতাংশ |
| শক্তি | ১২১ ক্যালরি |
| প্রোটিন | ২০ গ্রাম |
| চর্বি | ৪ গ্রাম |
| ক্যালসিয়াম | ১৪ মিলিগ্রাম |
| লৌহ | ০.৭ মিলিগ্রাম |
| ভিটামিন বি | ০.১ মিলিগ্রাম |
| ভিটামিন বি-২ | ০.১৬ মিলিগ্রাম |
| নিয়াসিন | ১১.৬ মিলিগ্রাম |
| ম্যাগনেসিয়াম | ২০ মিলিগ্রাম |
| পটাশিয়াম | ১৮৯ মিলিগ্রাম |
ব্যাম্বু চিকেন কিভাবে রান্না করতে হয়?
যেহেতু বাঁশের ভেতরে রান্নার সময় নাড়াচাড়া করার সুযোগ থাকে না তাই মুরগির মাংস ছোট ছোট করে কাটতে হয়। মাংস, তেল, মশলা সব একসাথে মেরিনেট করে ৩০ মিনিটের জন্য রেখে দিতে হয়। বাঁশের চোঙ পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিস্কার করে তাতে মেরিনেট করে রাখা মাংস পুরে দিতে হবে।
তারপর মুখ বন্ধ করে দিয়ে আগুনে বাঁশ পোঁড়াতে হবে। বাঁশ পুড়ে কালো হয়ে গেলে বুঝতে হবে রান্না হয়ে গেছে। বাঁশ যেন একদিকে পুড়ে না যায় সেজন্য একটু পর পর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হবে।
ব্যাম্বু চিকেন রান্নার কৌশল?
- হাড়ছাড়া মুরগীর মাংস ৫০০ গ্রাম
- গরম মসলা ১ টেবিল চামচ
- লেবুর রস ১ টেবিল চামচ
- ধনে গুড়ো ৩ টেবিল চামচ
- মরিচের গুড়ো ১ টেবিল চামচ
- আদা রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ
- লবণ পরিমাণ মতো
- হলুদ গুড়ো ১/২ টেবিল চামচ
- ধনে পাতা কুচি স্বাদ মতো
- কাঁচামরিচ ২/৩ টি
- অলিভ ওয়েল ১ টেবিল চামচ
- কাঁচা বাঁশের গেরো ১টি (৫০০ গ্রাম মুরগী ধরে এমন লম্বা)
- কলা পাতা
রন্ধন প্রণালী
রান্নার জন্য প্রথমেই মুরগীর মাংস থেকে হাড় ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিন। সব ধরণের মসলা মাংসের উপর ছড়িয়ে দিন। এবার লবণ যোগ করুন। সবশেষে এক টেবিল চামচ অলিভ ওয়েল দিন।
বিকল্প হিসেবে সোয়াবিন কিংবা সরিষার তেলও ব্যবহার করতে পারবেন। তবে তেলের পরিমাণ কম ব্যবহার করতে হবে। সবকিছু যোগ করা হয়ে গেলে এবার ভালোভাবে মাখিয়ে নিন।
সব মসলা যেন মাংসের ভেতের ঢুকে সেজন্য ২০-৩০ মিনিট ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখে দিন। এরই মধ্যে বাঁশের চোঙ প্রস্তুত করুন। চোঙটি পরিস্কার পানি দিয়ে কয়েকবার ধুয়ে নিন। ব্যাম্বু চিকেন কি পরিমাণ রান্না করবেন সে অনুযায়ী বাঁশ সংগ্রহ করুন।
৩০ মিনিট পর মেরিনেট করে রাখা মাংস বাঁশের চোঙের ভেতর প্রবেশ করান। শেষে বাঁশের চোঙটি ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিন। খেয়াল রাখতে হবে চোঙের ভেতরে যেন কোন ফাঁকা না থাকে।
তারপর কলাপাতা দিয়ে বাঁশের চোঙের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। এবার চোঙের খোলামুখ একটু উপরের দিকে রেখে কয়লা কিংবা লাকড়ির আগুনে পোড়াতে হবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে ব্যাম্বু চিকেনের বাঁশ যেন শুধু একদিকে না পুড়ে।
যেদিকে বেশি পুড়বে সেদিকের মাংস একটু বেশি সেদ্ধ হবে তাই সবদিক সমান হারে পোঁড়াতে হবে। সে কারণে নির্দিষ্ট সময় পর পর চোঙটি ঘুরিয়ে দিতে হবে।
বাঁশ সবদিকে সমানভাবে পুড়ে কয়লা হয়ে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে নিন। তারপর ঠাণ্ডা পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে নিন। এতে বাঁশটিও দ্রুত ঠাণ্ডা হবে এবং ছাই উড়ার সম্ভাবনাও কম থাকবে। বাঁশ হাতে ধরার মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভেতরের মাংস গরম গরম পরিবেশন করুন।
