তেভাগা আন্দোল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। মাঠে মাঠে নিরীহ কৃষক হত্যা, নারীদের উপর বর্বর পৈশাচিক নির্যাতন মানবতাকে করেছে কলুষিত। এ আন্দোলন খেটে খাওয়া মানুষের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন। জমিদার, জোতদারের হিংস্র থাবা থেকে আত্মরক্ষার আন্দোলনের নাম তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬ এ শুরু হওয়া এ আন্দোলন দুই বাংলার চাষা, মজুর, কৃষকদের এক সারিতে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্ব মানবতা দেখেছে সেদিন বাঁচার লড়াই কত শক্তিশালী। বর্গাচাষীরা ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে সেদিন রুষে ফুলে ফেপে উঠেছিলো জমিদার ও জোতদারের বিরুদ্ধে। ইতিহাসের এই ক্ষত চির জীবন্ত।
তেভাগা আন্দোলন কি
শাব্দিক অর্থেই স্পষ্ট এ আন্দোলনের ব্যাখ্যার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা একেবারেই আবশ্যক নয়। তিন ভাগকে এক কথায় বললে হয় তেভাগা। প্রশ্ন হলো কিসের ভাগ? এ ভাগ রক্ত আর ঘামের ফসলের। মোঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষি জমির মালিকানা ছিলো কৃষকের। মোঘলদের পর নবাবের পরাজয়ের পর নেমে আসে মানবতার অশুভ ছায়া। ব্রিটিশরা এ দেশ দখলে নেয়ার পর বিলুপ্ত করা হয় জমির মালিকানা। শুরু হয় জমিদারি প্রথা। তখন সকল জমি জমিদার ও ভূস্বামীদের মধ্যে চড়া দামে বিনিময় করে হিংস্র ব্রিটিশরা। ফলে ভূমিহীন কৃষকদের ভাগে চাষের কোন জমি ছিলো না। ভূস্বামী আর জমিদারদের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতো তারা।
বর্গা বলতে জমির মালিক জমিতে চাষ করতে দেয়ার বিনিময়ে অর্ধেক ফসলের ভাগ নেবে। জমি চাষের যাবতীয় খরচ করার পরও কৃষক পাবে বাকি অর্ধেকের ভাগ। জমিদার বা ভূস্বামী এবং কৃষকের মাঝে থাকতো আরও একটি মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণি তারা ফসল বা খাজনা আদায়ের নামে কৃষকের অর্ধেক অংশ থেকে ভাগ উসুল করে নিতো। এর ফলে কৃষকের খরচ বাদে অবশিষ্ট যা থাকতো তা জীবনধারণের জন্য অতি সামান্য। যুগের পর যুগ দুই বাংলার প্রায় অর্ধকোটি কৃষক চরম এই ভোগান্তি নিয়তি মেনেই বেঁচেছিলো চাতকের মতো। শেষে খাজনা হিসেবে ফসলের পরিবর্তে জোতদাররা টাকা চাইতে গেলেই বাঁধে বিপত্তি। জরিপ ছাড়াই কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা খাজনা দাবি করলে তা দেয়া কৃষকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না।
তাই কৃষকের উৎপাদিত ফসল দুই ভাগ না করে তিন ভাগ করে দুই ভাগের দাবি তুললো বর্গা চাষীরা। ফসলের তিন ভাগের দাবিতে দুই বাংলার সকল ভূমিহীন বর্গা চাষীরা একমত হলে দুই বাংলায় একযোগে শুরু হয় আন্দোলন। এই আন্দোলন তেভাগা আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসকে করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে চাষীদের জয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের ইতিহাসের কালিমা মোচন হলো।
কিভাবে শুরু হলো তেভাগা আন্দোলন?
ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ এবং প্রান্তিক মানুষদের উপর চলতো যত শোষণ। মোঘলদের শাসনামলে কৃষকদের স্বস্তির কমতি ছিলো না। উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশ বা তার কম পরিমাণ খাজনা দিলেও চলতো। তখন কৃষি জমির মালিকানা ছিলো কৃষকদেরই।
ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলের পর চালু হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এর ফলে জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের দখলে। জমির উর্বরতা ও পরিমাণের ভিত্তিতে জমিদাররা খাজনা দিতো ব্রিটিশদের। তবে জমিদাররা সরাসরি জমি চাষ করতো না। তারা শুধুই জামির মালিক ছিলো। জমি চাষ করতো চাষী এবং কৃষকরা। জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন (ইজারা) নিয়ে কৃষকদর দিয়ে জমি চাষ করাতো মধ্যসত্ত্বভোগী জোতদার।
তারা কৃষকদের দিয়ে জমি চাষ করিয়ে অর্ধেক ফসল নিজেরা আদায় করে নিত। এ প্রথা আধিয়ারী প্রথা হিসেবে তৎকালীন সমাজে পরিচিত ছিলো। আধিয়ারী প্রথা মেনেই দীর্ঘদিন চাষীরা জোতদারের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতো। আধিয়ারী, জোতদারি আর জমিদারি প্রথা প্রান্তিক কৃষকদের শুধুই ক্ষেতমজুর বানিয়ে রেখেছিলো দিনের পর দিন। এক পর্যায়ে নিরীহ কৃষকদের উপর খাজনা বাবদ ফসল নয় নগদ টাকার বোঝা চাপিয়ে দিলো জল্লাদ জোতদাররা।
তারা ফসলের বদলে টাকা নিতে শুরু করলো। ফসল বিক্রির টাকা যথেষ্ট না হলে গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে হলেও খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য ছিলো নিরুপায় বর্গা চাষীরা। মহাজনদের টাকা শোধ করতে না পেরে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে চাষীরা। বুকের ভেতর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। অস্তিত্ব বাঁচাতে সংগঠিত হতে থাকে চাষীরা। দানা বাঁধতে শুরু করে তেভাগা আন্দোলন।
১৯৩৬ সাল। নিপীড়িত বর্গা চাষী আর কৃষকরা সোচ্চার হয়ে উঠে। দুই বাংলার সোচ্চার কৃষকরা গঠন করেন নিখিল ভারত কৃষক সভা। লাঙ্গল যার জমি তার শ্লোগানে সংঘবদ্ধ কৃষকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। যুক্ত হয় তৃণমূলের কৃষক সমাজ। শেষে ১৯৪০ সালে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব উঠে। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত কমিশন ফ্লাউড কমিশন এ প্রস্তাব উত্থাপন করে।
ফ্লাউড কমিশনের প্রস্তাবনা
দেশের কৃষকদের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা জটিল কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই ফ্লাউড কমিশন কৃষকদের সমস্যা সমাধানে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলো। এ প্রস্তাবনায় কৃষকদের স্বার্থকেই বড় করে দেখা হয়েছিলো। ফ্লাউড কমিশনের মূল প্রস্তাবনাগুলো ছিলো:
-
-
- জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ
- কৃষকদের সরাসরি প্রজা হিসেবে মূল্যায়ন করা
- কৃষকদের কৃষি জমির মালিকানা প্রদান
- কৃষকের উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষককে প্রদান করা এবং
- জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’ প্রথা উচ্ছেদ
-
ফ্লাউড কমিশনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগেই ১৯৪৩ সালে দেশজুড়ে দেখা দেয় মহামারি। বাজারে চালের মজুদ না থাকায় দিন দিন বাড়ছিলো ভুখা মানুষের মিছিল। স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি থাকায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয় গ্রামের মানুষ। ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে দরিদ্র কৃষক। একটু ত্রাণের আশায় দলে দলে ছুটছে মানুষ শহরের দিকে। পথে পথে ধুঁকছে অচলপ্রায় মানুষগুলো। বাড়ছিলো হাড্ডিসার লাশের মিছিল। ঝিমিয়ে পড়েছিলো তেভাগা আন্দোলন। বাংলা ১৩৫০ সালের এ দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশের মন্বন্তর হিসেবেই বিশ্ব মানবতার পায়ে আছড়ে পড়ে। বিদেশি ত্রাণ সহযোগিতা আসলে তা প্রত্যাখ্যান করে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। প্রকৃত অর্থে ব্রিটিশ সেনা ও যুদ্ধে নিয়োজিতদের জন্য চালের মজুদ করায় এ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিলো। এ দুর্ভিক্ষে দুই বাংলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলো। এ সময় তেভাগা আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে পরে আবার বহুগুণ বেশি শক্তি নিয়ে জেগে উঠে কৃষকরা। নির্যাতন আর দুর্ভিক্ষ তাদের আন্দোলনকে থামাতে পারেনি বরং আরও বাড়তি শক্তি যুগিয়েছে।
১৯৪৬ সাল। দুই বাংলায় শুরু হয়ে গেলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। হিন্দুদের উপর মুসলিমদের আক্রমণ, মুসলমানদের উপর হিন্দুদের পাল্টা আক্রমণ। পথে পথে রক্তাক্ত লাশ। সাম্প্রদায়িক হ্রেষাহ্রেষি যেমন ছিলো তেমনি হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধও ছিলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে সাম্প্রদায়িক বিভেদের জাল ছিড়ে কৃষকরা আবারও সংঘবদ্ধ হয়। এবার কৃষকদের পাশে বজ্রশক্তি হয়ে পাশে দাঁড়ালো কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নতুন উদ্যমে শুরু হয় বর্গা চাষী ও কৃষকের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের আন্দোলন। ঘোষণা করা হয় নতুন কর্মসূচি। এখান থেকে শুরু হয় জোরদার তেভাগা আন্দোলন।
তেভাগা আন্দোলনের কর্মসূচি:
১) উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ দেয়া হবে ভূস্বামীদের
২) যেসকল ভূস্বামী তিন ভাগের এক ভাগে রাজি হবে না তাদের জমি চাষ করবে না বর্গাচাষীরা
৩) উচ্চবর্ণ হিন্দু বাড়িতে কোন নমশূদ্র কিংবা মুসলমান কাজ করবে না।
৪) বারুইদের কাছ থেকে পান ক্রয় করবে না কৃষকরা, প্রয়োজনে পান চাষ করবে।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ কৃষকরা ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পঞ্চগড়, জলপাইগুড়ি পর্যন্ত তৃণমূলের কৃষকদের সংগঠিত করা হয়। সমিতি গঠন করে মহিলা কর্মী গড়ে তোলেন কৃষকরা। গঠন করেন সংগ্রামী তহবিল। কৃষকদের রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেয় কমিউনিস্টের নেতারা। সম্মুখ সারিতে থেকে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন হাজী দানেশ, অজিত বসু, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, ইলা মিত্র, কংসারী হালদার,সুশীল সেন, নুর জালাল, কৃষ্ণবিনোদ রায়, ভূপাল পান্ডা, রুপনারায়ণ রায়, ডা.গণেন্দ্রনাথ সরকার,কালী সরকার। দিনাজপুরের হাজী দানেশকে তেভাগা আন্দোলনের জনক বলা হয়। নেতারা বিভিন্ন এলাকায় বিভক্ত হয়ে বর্গা চাষী ও কৃষকদের সবসময় উদ্দীপ্ত করে রাখতো। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবার ফসল উঠবে কৃষকের গোলায়। জমিদার কিংবা জোতদাররা বাধা দিতে আসলে রুখে দাঁড়াবে কৃষকরা। সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গেলেই কৃষকদের সাথে শুরু হয় পুলিশ আর জোতদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর সংঘর্ষ। সংঘবদ্ধ কৃষকরা দলবেধে ধান কাটে আবার পুলিশ, লাঠিয়ালদেরও প্রতিহত করে। চাষীদের পাশে ঢাল হয়ে প্রতিরোধ করতো নারীরাও। প্রত্যেক অঞ্চলেই এমন স্বেচ্ছাসেবি দল ছিলো কৃষকদের।
তেভাগা আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা
আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে প্রথম শহীদ হন দিনাজপুরের সমির উদ্দিন ও শিবরাম মাঝি। ১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলনে যখন উত্তপ্ত বাংলা তখন ঠাঁকুরগাওয়ে উত্তাপ কম ছড়ায়নি। জেলার রানীশংকৈল উপজেলায় নারী, পুরুষ অকাতরে হাতের কাছে যে যা পেয়েছি তা দিয়েই প্রতিহত করেছে পুলিশকে। পুলিশ নারীদের অসম্মান করে কথা বললে সে পুলিশকে সারারাত আটকে রাখে সবাই মিলে।
চাষী ও পুলিশের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ বাধে পঞ্চগড়ে। জেলার আটোয়ারি উপজেলার রামপুর গ্রাম। পঞ্চগড়ের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সুশীল সেনের উপস্থিতিতে ফুলঝরি নামের এক ভলান্টিয়ারের জমিতে ধান কাটতে গেলে এ সংঘর্ষ বাধে। এসময় পুলিশের আঘাতের বিরুদ্ধে গাইন হাতে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন একজন রাজবংশী তরুণী বিধবা দ্বীপশরী বর্মনী। অন্য কৃষক কর্মীরা তাকে অনুসরণ করে। দ্বীপশরী গাইনের আঘাতে হাবিলদারের দাঁত ভেঙে যায়। পুলিশ হটে যেতে বাধ্য হয়। বর্গাদারদের এ বিজয় পুরো আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে দেয়। ঘটনার পনের দিনের মধ্যে তখনকার দিনাজপুর জেলার ত্রিশটি থানার বাইশ টিতে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় লাখ লাখ বর্গাচাষী নিজের গোলায় ধান তোলে। নিরুপায় হয়ে হাজার হাজার কৃষক ও নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরদিন সমগ্র ভারতের কৃষক সভার সভাপতি মুজাফফর আহমেদ এবং বাংলার কৃষক সভার সভাপতি কৃষ্ণবিনোদ রায় হাজার হাজার কৃষককে গেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন।
৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের তালপুকুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সমিরুদ্দিন নামে এক বর্গাচাষী। ক্ষুব্ধ হয়ে তীর নিক্ষেপ করে শিবরাম মাঝি। তার ছোড়া তীরে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়। পাল্টা জবাবে অন্য পুলিশ সদস্যের গুলিতে নিহত হন শিবরাম মাঝি।
৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নীলফামারির তগনারায়ণকে অতর্কিত গুলিতে হত্যা করে জোতদার মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাহিনী। ২০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমায় খাঁ পুরে কৃষকদের ওপর পুলিশ ১২১ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ২২ জন কৃষক মারা যায়।
তেভাগা আন্দোলনে নারীর অবদান
নাচোলের রানী ইলা মিত্র, দীপপুরী, শিখা বর্মনী, রাজবংশী মেয়ে ভাগুনী, জয়বর্মনী, মাতিবর্মনী, এবং নড়াইলের নমশূদ্র কৃষকবধূ সরলাদির নাম তেভাগা আন্দোলনের আষ্টেপৃেষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। আন্দোলনে নারীদের এমন স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ অন্য এক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। চাষীরা যখন ধান কাটতো নারীরা তখন ঢাল হয়ে তাদের পাহাড়া। লাঠি হাতে পাহাড়া দিতো কেটে আনা ফসল। প্রতিবাদী নারীরা শুধু পাহাড়া দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেনি। প্রয়োজনে সামনে থেকেও সহ্য করেছে নির্যাতন। লাঠিয়াল ও পুলিশের হাতে ধর্ষিত হয়েছে বহু কিষাণি। ইলা মিত্র যিনি গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশ হেফাজতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছে।
সাহিত্য, গানে তেভাগা আন্দোলন
‘হেই সামালো ধান হে’ বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান তেভাগা আন্দোলনর যোদ্ধাদের উজ্জীবীত করতেই রচনা করেছিলেন সলিল চৌধুরী। তেভাগার আন্দোলন শুধু চাষীদেরই ছিলো না। সকল মহলের মানুষের সাথে শিল্পাঙ্গনের মানুষও আন্দোলিত হয়েছিলো। সোমনাথ হোড়ের দিনপঞ্জি ‘তেভাগার ডায়েরী’, ১৯৪৮-এ বড়া কমলাপুরে কৃষক-পুলিশ যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ এবং সালে নির্মিত পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ আন্দোলনকারীদের সাহস যুগিয়েছে। এছাড়াও গোলাম কুদ্দুস, পূর্ণেন্দু পাত্রী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো প্রথিতযশা শিল্পী সাহিত্যিকরা এ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
তেভাগা আন্দেলনের ফলাফল কি ছিলো?
সর্বশেষ ইলা মিত্রকে নির্যাতনের পর সারাদেশ তোলপাড় হয় এবং এর ফলেই সরকারেরও টনক নড়ে। আদালতে ইলা মিত্রের বয়ানে পাশবিক নির্যাতনের কথা জানাজানি হলে ক্ষুব্ধ হয় সব কৃষক, চাষীরা। মহাত্মা গান্ধীও তেভাগার ন্যায্য হিস্যার পক্ষে দাবি তোলেন। চাপের মুখে ভূস্বামীরা ৪০ শতাংশ বর্গা চাষীকে তেভাগা দিতে সম্মত হয়। তাতেও রক্ষা হলো না জমিদারদের। ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’-১৯৪৭ এর প্রেক্ষিতে ১৯৫০ সালে ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ পাস করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথা। তেভাগার সফলতার হাসিতে ভরে উঠে ত্যাগী চাষী আর কৃষকের ঘর।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া
জীবন সংগ্রাম, কমরেড মণি সিংহ
ইতিবৃত্ত
