বৌদ্ধ ধর্ম ভারতের বিহারে সৃষ্ট এক প্রাচীন ধর্ম। বর্তমানে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কম হলেও এক সময় বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি ছিলো অনেক বেশি। হিন্দু ভারতের প্রাচীনতম ধর্ম হলেও এক সময় মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করে। মানুষের ব্যাপকহারে ধর্মান্তরিত হওয়া সহজ কথা নয়। আকস্মিক অনেক মানুষের নতুন এক ধর্মমত গ্রহণ করার পেছনে রয়েছে ঘটনাবহুল ইতিহাস।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে তাকালে দেখা যাবে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ছিলো গোষ্ঠীভিত্তিক। তারা দলবেধে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়াতো। শিকারই ছিলো তাদের প্রধান পেশা। সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন আবিস্কারের ফলে ধীরে ধীরে প্রাচীন মানুষের উন্নতি হয়েছে। আবিস্কার এমনই বিষয় ছিলো সে সময় যা মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে দিতো। অনেক কিছু আবিস্কারের তাৎপর্য অনেক রকম ছিলো। সেকালে লোহা আবিস্কার ভারতবর্ষে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো। ভারতের হাজার বছরের পালিত সনাতন ধর্ম বিভাজন হয়ে বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তিতে বিহারের লোহার খনি আবিস্কার ও মজুদকৃত মূল্যবান লোহা ছিলো সবচেয়ে সহায়ক।
সামাজিক অন্ত:দ্বন্দ্ব প্রাগৈতিহাসিক শিকারি সমাজ থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত বিস্তৃত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ থেকে শুরু করে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনকালেই এ দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা ছিলো না। নানা কারণে, নানা ইস্যুতে তখনও সমাজে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিলো। আধুনিক সমাজের দ্বন্দ্ব যে কারণেই হোক না কেন ৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে থেকে ভারতবর্ষে সামাজিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্র ছিলো ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় শ্রেণি বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা। প্রাথমিকভাবে তখনকার ধর্মীয় লড়াইটা ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ক্ষমতা দখলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। লোহার আবিস্কার ও ব্যবহারের ফলে উদ্বৃত্ত পণ্য বিপননের প্রয়োজনে ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি করতে থাকে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্যে উন্নতি করায় উদ্ভূত বৈশ্য শ্রেণির ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবানদের মধ্যে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভাব হয় তখন। বৈশ্য শ্রেণি উন্নতি করে বেশি শক্তিশালী হতে থাকলে এক সময় তারা রাজকীয় ক্ষমতা দখলের ইচ্ছা করে। সে কারণে তারা সে সময় নিজেদের সংগঠিত করে নিজেদের আলাদা ধর্ম প্রচার করতে শুরু করে। আমরা যে ধর্মকে জৈন ধর্ম বলে জানি তা-ই হলো তখনকার সময়ের বিহারের বৈশ্যদের (বণিকদের) ধর্ম। তাদের প্রথম তীর্থঙ্কর (পথ প্রদর্শক/শিক্ষক) ছিলেন ঋষভদেব। তখন থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত তারা কঠোর নিরামিষাশী।
৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে গোটা ভারতবর্ষ ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিলো। তারা সবাই ছিলো আর্য (ইন্দো-ইরানীয় জাতিগোষ্ঠী)। তারা ভারতবের্ষর ১৬টি এলাকায় নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেছিলো। তৎকালীন সময়ে ভারতের লোহার খনির আবিস্কার হওয়ায় সবাই বিহার অঞ্চলের মগধের প্রতি সবার আকর্ষণ ছিলো। মগধরা ছিলো তখন সবচেয়ে শক্তিশালী। আর এ সময় বিহারের নিরামিশাষী বৈশ্যরা নিজেদের জৈন ধর্মকে প্রচার করতে শুরু করে। এছাড়া বৈশ্যরা এক সময় আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাকায় ধর্মীয় সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতো না। কারণ তখন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মূলে ছিলো পশু বলি এবং যজ্ঞ যা ছিলো খুবই ব্যয়বহুল। সে কারণে তখন শুধু বিত্তশালীরাই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারতো।
ধর্মকর্ম তখন সাধারণ মানুষের নাগালের একেবারে বাইরে ছিলো। আর্য-ব্রাহ্মণদের যাগ যজ্ঞের ধর্ম অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল হওয়ায় এবং সাধারণ মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করতে না পারায় অনার্যদের সহজ ধর্মীয় সংস্কার, ধর্মীয় রীতিরেওয়াজ এবং উপাসনার পদ্ধতি সাধারণ মানুষ ব্যাপকহারে গ্রহণ করতে শুরু করে। এ সময় ৬০টি ধর্মাবলম্বী মানুষ অনার্যদের ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে এবং সনাতন ধর্ম ত্যাগ করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে শীর্ষে ছিলো বৈশ্যদের জৈন ধর্মাবলম্বীরা।
অপরদিকে বৈশ্যরা নিরামিষাশী হওয়ায় তারা পশু বলি দেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বৈশ্যরা তখন তৃতীয় শক্তি হওয়ায় তাদের প্রভাব গোটা ভারতবর্ষে বিস্তার লাভ করে। বৈশ্যদের ধর্মীয় এ নীতির সুযোগে সিদ্ধি লাভ করা গৌতম সিদ্ধার্থ বুদ্ধ তার লাভ করা জ্ঞান জৈনদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন খুব সহজেই। উল্লেখ্য, তখন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে ছিলো চরম বিরোধ। গৌতম বুদ্ধ ক্ষত্রিয় রাজবংশের রাজপুত্র ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের ধর্মীয় জ্ঞান ও সিদ্ধিপ্রাপ্ত জ্ঞান জৈনদের আকৃষ্ট করায় তারা ধীরে ধীরে বুদ্ধের অনুসারী হতে থাকে। জৈনরা নিজেদের ধর্মীয় সংস্কার থেকে সরে গৌতম সিদ্ধার্থের ধর্মানুসারী হওয়ায় পরবর্তীতে তা বুদ্ধের ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম হিসেবে ভারতবর্ষ, এশিয়া মহাদেশ এবং গোটা বিশ্বে বিস্তার লাভ করে।
গৌতম বুদ্ধ
গৌতম বুদ্ধ যার পুরো নাম সিদ্ধার্থ গৌতম। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন নেপালের শাক্য রাজবংশের ব্রাহ্মণ রাজ পরিবারের রাজপুত্র। বুদ্ধের জন্ম, মৃত্যু ও পরিচয় নিয়ে অনেকের মধ্যেই রয়েছে নানা মত। ইতিহাসবিদগণ এ বিষয়ে কালে কালে নানা মত ব্যক্ত করে গেছ্নে। তবে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে, গৌতম বুদ্ধ ছিলেন ব্রহ্মর্ষি অঙ্গিরসের বংশধর। এর ফলে বুঝা যায় তিনি অঙ্গিরস সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
সন্ন্যাসী জীবনযাপন এবং ধ্যানের মাধ্যমে সিদ্ধার্থ গৌতম ভোগপরায়নতা এবং রিপু দমনে সিদ্ধি লাভ করেন। বৌদ্ধ পরম্পরা এবং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী জানা যায় ধ্যান সাধনার মাধ্যমে তিনি সংযমী পথ আবিস্কার করেছিলেন। বর্তমান ভারতের বুদ্ধ গয়ায় অবস্থিত বোধি বৃক্ষের তলায় তিনি প্রথম সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। বোধি বৃক্ষটি মূলত একটি অশ্বত্থ গাছ। সিদ্ধিলাভের পর থেকেই তিনি ‘আলোকিত’ ব্যক্তি হিসেবে সর্বজন সমাদৃত হন।
সিদ্ধলাভের পর তিনি তার মত, পথ এবং নীতি আদর্শ প্রচার শুরু করেন। তৎকালীন মগধ সম্রাট বিম্বিসার তার মতবাদ ও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং গৌতমকে তা প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বুদ্ধের প্রতি খুশি হয়ে তিনি তখন উত্তর-পূর্ব ভারতের ঐ অংশে অনেকগুলো বিহার নির্মাণের আদেশ দেন। রাজা বিম্বিসারের নির্মিত অনেকগুলোর বিহারের জন্যই ভারতের ঐ অঞ্চলের নামকরণ হয় বিহার যা বর্তমান ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য।
সর্বপ্রথম উত্তর ভারতের বর্তমান বারাণসীর হরিণ পার্কে পাঁচ সঙ্গীকে দীক্ষা দেন গৌতম বুদ্ধ। এই পাঁচ সন্নাসী মিলে প্রথম একটি সংঘ গঠন করেন। তখন থেকেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ভিক্ষু এবং সন্ন্যাসীনিদের ভিক্ষুণী বলে অভিহিত করা হয়। প্রথমে ইচ্ছা না থাকলেও পরে ভিক্ষুণীদেরও সংঘের আওতাভুক্ত করেন গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধের মাসি এবং সৎ মা মহাপ্রজাপতি গৌতমী ছিলেন তার সংঘের প্রথম ভিক্ষুণী।
গৌতম বুদ্ধের বাকি জীবন ভারতের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য গাঙ্গেয় সমভূমি এলকাগুলো ভ্রমণ করে কেটেছে। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের কয়েক দশক আগে গৌতমবুদ্ধ কুশীনগরের পরিত্যাক্ত এক জঙ্গলে দেহত্যাগ করেন। গৌতম বুদ্ধের দেহত্যাগের পর শত শত পণ্ডিত ভিক্ষু তিনটি সঙ্গায়নে বুদ্ধবাণী সংরক্ষণ শুরু করেন। সংরক্ষিত সকল বাণির সম্মিলিত প্রকাশনের নাম ত্রিপিক। ত্রিপিটকই বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।