টিপু সুলতান ভারতীয় উপমহাদেশে এক হার না মানা বীর। পিতা হায়দার আলী, মাতা ফাতিমা ফখর-উন-নিসা। টিপু সুলতানের পুরো নাম সুলতান ফতেহ আলী সাহেব। ১৭৫০ সালের ১০ নভেম্বর ব্যাঙ্গালোরের দেবনাহল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ‘টিপু মস্তানা আউলিয়া’ নামের এক বুজুর্গ ব্যক্তির আশীর্বাদে হায়দার আলী পুত্র সন্তানের জনক হতে পেরে খুশি মনে সন্তানের নামনকরণ করেন টিপু। অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে ১৮ শতকের মহীশূরের বাঘ বলে মানা হয়। উত্তরাধিকার বলে টিপু সুলতান ১৭৮২ সালে সিংহাসনে আসীন হন।
বাবা দক্ষ সেনা হলেও শিক্ষা-দীক্ষা বেশি দূর হয়নি। সে কারণে ছেলে টিপুকে সব ধরণের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। রণকৌশল আর সমর বিদ্যায় শুরু হয় টিপু সুলতানের প্রাথমিক শিক্ষা। পরে উর্দু, আরবি, ফারসি এবং কন্নড় ভাষায় গভীর জ্ঞান অর্জন করেন তিনি। অশ্বারোহন, তীরন্দাজি এবং তলোয়ার চালনায় ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নিপুণ।
টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ন্যায়পরায়ণ শাসক। তার দৃঢ়তা ও সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাকে শের-ই-মহীশূর উপাধিতে ভূষিত করে। টিপু সুলতান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। ১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি মহীশূরের ময়দানের বাবার সাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। ১৭ বছর বয়স থেকে রাজ্যের কূটনৈতিক ও সামরিক দায়িত্ব অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পালন করেন। জনশ্রুতি আছে এমন বীর সন্তানের জন্যই তার পিতা দক্ষিণ ভারতের প্রভাবশালী শাসক ছিলেন।
টিপু সুলতান কেমন শাসক ছিলেন?
একজন শাসক হিসেবে যতটা দক্ষতা, সাহস, সততা এবং উদারতা থাকা দরকার তার ষোলআনার অংশীদার ছিলেন টিপু সুলতান। রাজ্যের উন্নয়নে সব ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। তার শাসনামলে কৃষি, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান ও সামরিক খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছিলো। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভারতীয় হিসেবে নতুন নতুন উদ্ভাবনও করেছিলেন তিনি। রেশম উৎপাদন করে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে জুড়ে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছিলেন তিনি। চালু করেছিলেন নতুন মুদ্রা।তিনতুন মৌলুদি লুনিসোলার ক্যালেন্ডারও আবিস্কার করেন তিনি।
শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে ধাতব শমরাস্ত্র আবিস্কার করেন তিনি। এই অস্ত্রই ছিলো সে সময়ের সবচেয় আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র যা দুই কিলোমিটার দূরে থাকা শত্রু ঘাঁটিতে আক্রমণ করতে সক্ষম ছিলো। গঠন করেছিলেন সামরিক কমিশন ফাতহুল মুজাহিদীনকে কমিশন। মহীশূর রাজ্যের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাও চালু করেছিলেন তিনি। তার রাজ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিলো শূন্যের কোঠায়। রাজকার্যে সকল পর্যায়ে মুসলিমদের পাশাপশি হিন্দুরাও বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন। প্রায় ১৫৬টি হিন্দু মন্দিরে তিনি নিয়মিত অনুদান দিয়ে গেছেন তিনি। তার সকল কর্ম আজ সত্যিই অতীত আর ইতিহাস হয়ে গেছে। হিন্দু মৌলবাদী ভারতীয় বিজেপি সরকারের কাছে তিনি আজ সাম্প্রদায়িক।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে টিপু সুলতানের অবদান
টিপু সুলতানের সাথে ব্রিটিশদের বিরোধ সৃষ্টি হয় ১৭৭৯ সালে। ফরাসিদের দুর্গ দখল করেছিলেন তিনি। ১৭৮২ সালে পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে মহীশূরের সিংহাসনে বসেন এই শের। রাজ্যের শাসনকার্যের ভার কাঁধে নেয়ার পর ব্রিটিশ তাড়াতে সংকল্প করেন তিনি। তাই কিছু দিন না যেতেই ব্রিটিশদের সাথে আবারও যুদ্ধ হয়। এবার যুদ্ধে হায়দ্রাবাদ ও মারাঠারা সুলতানের বিরোধিতা করলে একাই দুই পক্ষের সাথে লড়াই করেন। ভারতীয়দের সাথে যুদ্ধ শেষ হলেও ব্রিটিশদের সাথে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ১৭৮৪ সালে দ্বিতীয় মহীশূরের যুদ্ধের ইতি টানেন তিনি।
ভারতবর্ষ দখলের নেশায় মত্ত ছিলো ব্রিটিশরা। ব্রিটিশদের উৎখাত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন টিপু সুলতান। অথচ ভারতীয় হিন্দু রাজারা ব্রিটিশদের আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করে সমগ্র ভারতবর্ষ ১৯০ বছরের জন্য তুলে দিলো ব্রিটিশদের হাতে। তিনি ভাবতেন ব্রিটিশরা এ দেশে এসেছে ব্যবসার জন্য তাই তাদের ব্যবসা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকাই উচিত। তিনি ব্রিটিশদের বিরোধিতা করতে গেলেই তার বিরোধিতা করতেন অন্য রাজ্যের রাজারা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হায়দ্রাবাদ, মারাঠার রাজা উল্লেখযোগ্য। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও ইতিহাস সত্য, ভারতীয় হিন্দু রাজারা ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে টিপু সুলতানের বিরোধিতা করলেও ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়েন সুলতানকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাই টিপু সুলতানের পরাজয় ভারতীয় হিন্দুদের জন্য ঐতিহাসিক লজ্জা।
১৭৮৯ সালে তৃতীয়বারের মতো আবারও ব্রিটিশদের সাথে টিপু সুলতানের যুদ্ধের শঙ্কা দেখা দেয়। তবে এবার ঘটে অন্য ঘটনা। ত্রিবাঙ্কুরের রাজা প্রকাশ্যে ইংরেজদের সাথে জোটবদ্ধ হয়। ইংরেজদের তারা আশ্রয় দেয়। ক্ষিপ্ত হয়ে সুলতান ইংরেজদের সেই সহযোগী রাজ্যে আক্রমণ চালায়। এর মধ্য দিয়েই ১৭৯০ সালে তৃতীয় মহীশূরের যুদ্ধের সূচনা ঘটে। এ যুদ্ধে সুলতানের বিপক্ষে অবস্থান নেয় ইংরেজ ও মারাঠারা। এর ফলে বেশ কয়েকটি এলাকা হারাতে হয় সুলতানকে। তাদের বিরুদ্ধে একাই লড়াই চালিয়েছেন। এ যুদ্ধের কোন মীমাংসা হয়নি।
১৭৯৯ সালে আবারও যুদ্ধের ডাক দেন টিপু সুলতান। এটিই চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূরের শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তিনি মারাঠা, হায়দ্রাবাদ এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করেন। ইংরেজদের পক্ষে এ যুদ্ধ নেতৃত্ব দেয় লর্ড ওয়েলেসলি। এই শেষ যুদ্ধে সেনাপতির যড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি। সুলতানের সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে নিহত হয় টিপু সুলতান।
দক্ষিণ ভারতের শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রামের কাবেরি নদীর একটি ব-দ্বীপে নিজ দুর্গ থেকে রাজ্য পরিচালনা করতেন সুলতান। শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রাম বর্তমানে কর্ণাটক রাজ্যের মাণ্ডিয়া জেলার অন্তর্গত। সুলতানের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে ভেলোরের একটি দুর্গের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখে ব্রিটিশরা। কয়েক বছর পর ১৮০৬ সালে ব্রিটিশবিরোধী একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ বিদ্রোহে শতাধিক ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়। এ ঘটনার ক্ষোভে ইংরেজ সরকার সাধারণ মানুষের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। প্রায় ৬ শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ব্রিটিশ রাক্ষুসেরা।
তবে এ ঘটনায় সুলতানের রাজপুত্রদের দিকেই সন্দেহের তীর ছুড়ে তারা। উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় সুলতান পরিবারের একটি বড় অংশকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাকি যারা দুর্গে রয়েছিলো তাদের মৃত্যুর পর টিপু সুলতান গ্র্যান্ড মসজিদ প্রাঙ্গনে কবর দেয়া হয়। টিপু সুলতানের কলকাতায় বসবাসরত বংশধরদের পরম্পরা সম্পর্কে পরে আর বিশেষ কোন খবর পাওয়া যায়নি। কলকাতায় স্থানান্তরিত কনিষ্ঠ শাহজাদা ওয়াহিদ উল্লাহ সুলতান পালিয়ে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে এসে আশ্রয় নেয় এবং নাম পরিবর্তন করে এখানে বাস করতে শুরু করে।