ঈশা খাঁ: বীরত্বে অমর এক বীরের গল্প

ইতিহাস সত্য, ইতিহাস জন্ম দেয় নতুন ভবিষ্যতের, আমাদের দেখায় নতুন পথ। ইতিহাসের বুকে অনেক ক্ষত কিন্তু আশ্চর্যে্যর হলেও চিরন্তন সত্য ইতিহাসের কোন কষ্ট নেই, কারণ ইতিহাসেরও আছে অনেক গৌরবগাঁথা। হাজার বছরের ইতিহাস বুকে ধারণ করে আছে অনেক বীরের উপাখ্যান। বাংলার ইতিহাসে এমনই এক বীরের নাম ঈশা খা।

ঈশা খাঁ মধ্যযুগীয় বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের কথা জানে না এমন শিক্ষিত মানুষ পাওয়া যাবে না। ঈশা খা বারো ভূঁইয়াদেরই এক অন্যতম শাসনকর্তা যাকে বলা হয় মসনদ-ই-আলা। অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব আর উদারতার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর তাকে এই উপাধি দান করেন।

ঈশা খাঁ কিভাবে মুসলমান হলেন?

ঈশা খাঁ বাংলার বীর হলেও তার শেকড় অন্য কোথাও। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যার বাসিন্দা। ঈসা খানের দাদা ভগীরথ বাইস গোত্রের রাজপুত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

বাংলার সুলতানি আমলে তখন ছিলো সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের শাসনকাল। তখন ঈশা খার দাদা ভাগীরথ অযোধ্যা ছেড়ে বাংলায় আসেন এবং গিয়াস উদ্দিন শাহের দেওয়ান হিসেবে যোগদান করেন।

পূর্বপুরুষরা হিন্দু হলেও ঈশা খাঁ মুসলমান তার পের্তক সূত্র ধরেই। ভাগীরথের পুত্র কালিদাস গজদানী হলেন ঈশা খাঁর বাবা। তবে জীবনের শুরু থেকেই তিনি হিন্দু হলেও এক পর্যায়ে সুফি সৈয়দ ইব্রাহীম দানিশমান্দের নির্দেশনায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সোলেমান খাঁ নামে নতুন করে পরিচিত হতে থাকেন।

পৈতৃক সূত্রেই দেওয়ানী পদ লাভ করেন সোলেমান খা। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যা সৈয়দা মোমেনা খাতুনকে বিয়ে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে বসবাস শুরু করেন।

ঈশা খাঁর জন্ম ও শৈশব

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে ১৫২৯ সালে জন্ম হয় বাংলার মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর। তিনি ছাড়াও পরিবারে তার ছিলো এক ছোট ভাই ইসমাইল খাঁ এবং বোন শাহিনশা বিবি।

১৫৪৫ সালে দিল্লির সুরি সাম্রাজ্যের সম্রাট শের শাহ সুরি মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্য দিয়ে সুরি সাম্রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়। শের শাহর পুত্র ইসলাম শাহ তার বাবার স্থলাভিষিক্ত হন। তবে তার আনুগত্য স্বীকার করতে রাজি হননি ইসা খাঁর বাবা সোলাইমান খাঁ।

ইসলাম শাহ তখন তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দু’জন সেনাপতিকে পাঠান সোলাইমান খাকে দমন করার জন্য। সুলায়মান খান তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন বিদ্রোহী সোলাইমান খাঁকে এক পর্যায়ে কৌশলে হত্যা করেন ইসলাম শাহর সেনাপতিরা। এর মধ্য দিয়ে কিশোর ইসা খাঁ ও তার পরিবারে নেমে আসে সবচেয়ে কঠিন বিপর্যয়।

পিতার বিদ্রোহের বদলা নিতে ১৫৪৫ সালে ঈসা খাঁ ও তার ছোট ভাই ইসমাইল খাঁকে ইরানি বণিকদের কাছে ক্রিতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেন প্রতিহিংসায় অন্ধ ইসলাম শাহ সুরি। জীবনের এমন বিপর্যয় কখনো ভাবতেও পারেনি ঈসা খাঁ।

তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বাধ সাধে এমন সাধ্য কার থাকে । ইসলাম শাহর মৃত্যুর পর ১৫৬৩ সালে তাজ খান কররানী বাংলা ও বিহারের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ ছিলেন তার অনুগ্রহভাজন।

সে সুবাদে দরবারি কাজে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগও পান তিনি।  এ সময়ে তিনি তাঁর দুই ভাতিজা ঈসা ও ইসমাইলের খোঁজ পেয়ে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ইরানী বণিকের কাছ থেকে তাদের মুক্ত করে আনেন। তখন ইসা খাঁর বয়স ২৭ বছর।

তাজ কররানীর শাসনকালে ঈসা খাঁর চাচা দরবারি কাজে নিযুক্ত থাকায় তার প্রচেষ্টায় ঈসা খাঁ তার বাবার সরাইলস্থ জমিদারি ফিরে পান। পরে ১৫৬৫ সালে তাজ কররানীর মৃত্যুর পর আফগানদের হয়ে মোঘল আক্রমণ প্রতিহত করতে সোচ্চার হয়ে উঠেন তিনি।

ঈশা খাঁ যেভাবে বীর ঈশা খাঁ হয়ে উঠলেন?

ঈশা খাঁ দেশে ফিরে এসে চাচা কুতুব খানের চেষ্টায় আফগানদের কাছ থেকে তার পিতার সরাইলস্থ জমিদারি উদ্ধার করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর ঈসা খাঁ আফগান শাসকদেরকে মোঘল আক্রমণ মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তবে এ লড়াই টেকেনি বেশি দিন।

মাত্র ১১ বছর পর ১৬৭৬ সালে মোঘলদের কাছে পরাজিত ও নিহত হন তাজ কররানীর উত্তরসুরি দাউদ খান কররানি। দাউদ খানের পরাজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা আফগান শাসনের অবসান হয়। বাংলার মসনদ-ই –আলা বীর ঈসা খাঁর লড়াইয়ের গল্পও এখান থেকেই শুরু।

এ সময় স্বাধীনভাবেই রাজ্য পরিচালনা করছিলেন তিনি। তবে তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মোঘলদের তুলনায় তার সৈন্যবহর খুবই সামান্য। তবুও ভ্রুকুটি কাপেনি তার। নিজের সৈন্যবহর আর সীমিত শক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে আফগান দলপতি ও পূর্বাঞ্চলের সব জমিদারদের সাথে রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠন করেন।

ত্রিপুরা ও কামরুপের রাজা অমরমাণিক্য ও রঘুদেবের সঙ্গেও জোট গঠন করে ঈসা খাঁ। তিনি নিজে গঠন করেছিলেন একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী।

বাংলার বিশাল অঞ্চল তার আয়ত্ত্বে ছিলো। ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার খুব অল্প দিনেই তিনি তার রাজ্যের সীমানা বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার অর্ধেক, সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং বৃহত্তর রংপুর, বগুড়া ও পাবনার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো মসনদ-ই-আলা ঈসা খার সাম্রাজ্য।

শৌর্য-বীর্য আর নৈপুণ্যতায় ঈসা খাঁ ততদিনে এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেন যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে। তার এমন বীরত্বের শান-শওকতের গল্প শুনে ভয় ধরে গেলো মোঘল সম্রাটদের মনে।

অপ্রতিরুদ্ধ ঈসা খাঁকে দমিয়ে রাখতে দিল্লীর সম্রাট আকবর বাংলার সুবাদার করে পাঠান শাহবাজ খাঁকে। ঈসা খাঁর সাথে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে তুমুল যুদ্ধ হয় শাহবাজ খাঁ। যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন শাহবাজ খাঁ।

এতে আরও ভরকে গেলেন মোঘল সম্রাট। শেষে ১৯৫৭ সালে মোঘল সেনাপতি মানসিংহকে পাঠানো হয় ঈসা খাকে দমন করতে। ঈসা খাঁ-মানসিংহের যুদ্ধ বাংলার ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের সূচনা করে।

ঈশা খাঁ-মানসিংহের যুদ্ধ

তলোয়ার চালনায় ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে টিপু সুলতানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তবে ঈশা খাঁও কিছুতেই কম নয়। তার একের পর এক বীরত্বের গল্প আর মোঘলদের এলাকা দখলের পর যেন সম্বিত ফিরে পেলের মোঘল সম্রাট। নড়েচড়ে বসলেন দিল্লির সিংহাসন ছেড়ে। সম্রাট আকবর মোঘল সেনাপতি করে রাজস্থানের রাজা মানসিংহকে পাঠলেন বঙ্গে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে।

মানসিংহকে পাঠানোর এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো বীর ঈশা খাঁকে পরাজিত করা। ১৫৯৫ সালে দলবল, সৈন্য সামন্তসহ মানসিংহ রাজস্থান থেকে গাজীপুরের টোক নগরীতে তার রাজধানী সরিয়ে আনেন।

ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার সর্ব দক্ষিণের গ্রাম টাঙ্গার গ্রাম এবং গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক নগরী এ দুয়ের মাঝে রয়েছে শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গস্থল যার পূর্ব দিকে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার অবস্থান।

এই তিন নদী সঙ্গমের পূর্ব পাড়ে পাকুন্দিয়ার এগার সিন্দুরে রয়েছে ঈশা খাঁর একটি দুর্গ যা ঈশা খাঁর মাটির দুর্গ হিসেবেই বেশি পরিচিত।

মানসিংহ এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শেষে ১৫৯৬ সালে মানসিংহ আকষ্মিক ঈশা খাঁর দুর্গ আক্রমণ করেন। ঈশা খাঁর অনুপস্থিতিতেই এ যুদ্ধের সূচনা হয়। ইতিহাস মতে, দুর্গ আক্রমণের খবর পেয়ে  ছুটে আসেন বীর ঈশা খাঁ। ততক্ষণে  ‍যুদ্ধ করে ক্লান্ত ঈশা খাঁর সৈন্য সামন্ত।

তারা এতই ক্লান্ত যে, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই মানসিংহকে একক যুদ্ধের আহ্বান জানালেন বাংলার মসনদ-ই-আলা। ঈশা খাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন মোঘল সেনাপতি মানসিংহ।

তবে কথিত আছে প্রথমেই ছলনার আশ্রয় নেয় মানসিংহ। নিজে না এগিয়ে নিজের জামাতাকে এগিয়ে দেন। জামার যুদ্ধ নৈপুণ্যে ঈশা খাঁ বুঝতে পারেন তিনি মানসিংহ নন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিংহের জামাতাকে হত্যা করেন ঈশা খাঁ। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে শেষে নিজেই লড়াইয়ে লিপ্ত হলেন মোঘল সেনাপতি মানসিংহ।

দুজনের মধ্যে চলছে তুমুল লড়াই। তলোয়ারের ঝনঝনানি আওয়াজ অনুরণিত হচ্ছিলো বাতাসে। কেঁপে উঠছিলো বালুকাময় মাটি। এক পর্যায়ে ঈশা খাঁর তরবারির আঘাতে দিখণ্ডিত হলো মানসিংহের তলোয়ার।

নিরস্ত্র মানসিংহ বিষ্ময়ে অবাক। ভাবছিলো প্রাণ বুঝি এবার যাবে। কিন্তু তা হলো না। নিজের তরবারি নামিয়ে শত্রুর কাছে গিয়ে বললেন, নিরস্ত্রকে হত্যা করা ইসলামের রীতি নয়। এই নিন তরবারি। শক্তি পরীক্ষা করুন শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হবে জয় পরাজয়। বেকায়দায় পেয়ে কাউকে হত্যা কিংবা পরাজয়ে বাধ্য করা বীরধর্ম নয়।

ঈশা খাঁর কথা শুনে মানসিংহ অবাক। সারা জীবন যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়েছেন কিন্তু প্রতিপক্ষের মুখে এমন কথা শুনেননি কখনো। এমন হৃদয়বান বীর জীবনেও দেখেননি।

তার উদারতা মুগ্ধ হয়ে মানসিংহ বলে উঠলেন ‘এমন বীরের সাথে আর যুদ্ধ নয়। আমি আপনার শৌর্য-বীর্যে মুগ্ধ, অভিভূত। আমি পরাজয় স্বীকার করলাম। সত্যিই আপনি অদ্বিতীয় বীর।’

শেষে ঘোড়া থেকে নেমে যেতে বাধ্য হলেন মানসিংহ। কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন ঈশা খাঁকে। ইশা খাঁর এমন সাহসিকতায় মুগ্ধ হলেন মানসিংহ। তার সাথে সন্ধি করলেন এবং বন্ধুত্ব করলেন।

মানসিংহ শিবিরে ফিরে গেলে বাধে আরেক বিপত্তি। তার রানী তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, মোগল সম্রাট আকবর এ ঘটনায় মানসিংহকে হত্যা করবেন এবং তিনি বিধবা হয়ে যাবেন।

মানসিংহকে আরেকবার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে ঈশা খা নিজেই সম্রাট আকবরের দরবারের যেতে রাজি হলেন। ঈশা খাঁকে কাছে পেয়ে প্রথমে তাকে বন্দি করার আদেশ দেন। তবে মানসিংহের কাছে ঈশা খাঁর বীরত্বের গল্প শুনে হতবাক হলেন আকবর।

সম্রাট ঈশা খাঁকে ২২ পরগনার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান। তার অসীম সাহসিকতার এবং বীরত্বের জন্য তাকে ”বাংলার মসনদ-ই-আলা” উপাধিতেও ভূষিত করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *