মানুষের ইতিহাস নিয়ে কৌতুলের শেষ নেই। কোন ঘটনার ইতিহাস নয় মানুষের কালানুক্রমিক ইতিহাস যার মীমাংশা নিয়ে অনেক মত, তর্ক, বিতর্ক এবং নানা উপকথা প্রচলিত। ইতিহাস বলতেই আমরা মনে করি মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস, গুপ্ত বংশের রাজাদের ইতিহাস কিংবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আসলে মানুষের ইতিহাস নিয়ে আমরা আর ভাবি না। আধুনিক সভ্যতার প্রযুক্তির প্রবাহে আমরা নিজের সুপারম্যানও ভেবে থাকি কখনো কখনো। কিন্তু ইতিহাস এমনই ব্যাপার যা বারবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসে, কোন না কোনভাবে ফিরে আসে, মুহূর্তে মুহূর্তে ইতিহাস আমাদের সামনে ফিরে আসে। আমরা শুধু বর্তমানের সাথে ইতিহাসকে যুক্ত করতে পারি না। তবে চলুন দেখি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, বাস্তবতা আর বিজ্ঞানের চোখে মানুষের ইতিহাস কি এবং ইতিহাসের সাথে মানুষের সম্পর্ক কি?
মানুষের ইতিহাস বলতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো মহাবিশ্বের ইতিহাস। মাহাবিশ্বের ইতিহাস অনেক ব্যাপক তাই মাহাবিশ্বের অন্তর্গত ছোট একটি গ্রহ পৃথিবীর ইতিহাসই মূল আলোচ্য বিষয়। চলুন পৃথিবীর কিভাবে সৃষ্টি হলো সে ব্যাপারে একটু ধারণা নিই।
পৃথিবীর ইতিহাস
পৃথিবী সৌরজগতের একটি ছোট গ্রহ। পৃথিবী কবে সৃষ্টি হয়েছিলো সে ব্যাপারে বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট কোন ধারণা নেই তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে থাকেন ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিলো। ধারণা করা হয় থিয়া নামের একটি বৃহদাকৃতির গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ হয় বর্তমানে পৃথিবী নামের এই গ্রহের। এই সংঘর্ষের ফলে এই গ্রহ থেকে একটি ভগ্নাংশ বা গ্রহাণু ছিটকে সরে যায় বায়ুমণ্ডলে যা বর্তমানে চাঁদ হিসেবে আমরা দেখে থাকি এবং চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। সংঘর্ষের ফলে শুধু চাঁদেরই জন্ম হয়নি। প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে দেখতে বর্তমানের শুক্র গ্রহের মতো রূপ হয় পৃথিবীর। তখন পৃথিবীজুড়ে ছিলো শুধু গলিত লাভা যা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে লাভা জমাট বেঁধে হয় পাথর এবং পানি আলাদা হয়ে সৃষ্টি করে সাগর, মহাসাগর এবং বিভিন্ন মহাদেশ। মহাদেশগুলো নিচের অংশে রয়েছে বৃহদায়তনের টেকটোনিক প্লেট। এসব প্লেটে এক সময় পাওয়া যেত স্বর্ণ, রৌপ্যের মতো দামী সব ধাতু। বিজ্ঞানের ধারণা এ পর্যন্ত ইতিহাস প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগের।
৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সঞ্চার হয়। পাথরের গায়ে জন্ম নেয়া শ্যাওলার সাথে সূর্যের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। তখন প্রথম সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে ধারণা করে বিজ্ঞান। তবে তখন অক্সিজেনের মাত্রা বেশি হওয়ায় অনেক ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। এমন সব ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয় যেগুলোর সূর্যের আলো সহনীয় ক্ষমতা খুবই কম ছিলো। ফলে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়। ঠিক তখন থেকে প্রায় এক বিলিয়ন বছর শ্যাওলা বা উদ্বিজ্জ প্রাণির সৃষ্টি বা ধ্বংস হয়নি। এই ক্রান্তিকালকে বিজ্ঞান “Great Oxygenation Crisis” বলে মনে করে। তারপর কালক্রমে অনেক প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিস্তার ঘটতে থাকে প্রকৃতি ও জীবজগতের।
মানুষের ইতিহাস শুরু হয় পুরাপ্রস্তর যুগ থেকে। লিখন পদ্ধতি আবিস্কারের পরের সময় থেকে পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাসের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার আগে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞান কেবল ধারণাই পোষণ করে আসছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক জীবাশ্ম ও নানা প্রাগৈতিহাসিক উপকরণ গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে ইতিহাসকে বর্তমানের সাথে সংযোগ করার চেষ্টা করছেন মাত্র। আর এ সংযোগের ফলে যেগুলো মিলে যাচ্ছে সেগুলোর ধারণাই আমরা পেয়ে থাকি বাকি সব অমীমাংশিত যা গবেষণাগারে প্রক্রিয়াধীন। তবে লিখন পদ্ধতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় বিজ্ঞান আদিম মানুষ ও সভ্যতার ইতিহাসের সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছে।
মানুষের ইতিহাস
বিজ্ঞানীদের ধারণা ৩৮০ কোটি বছর আগে মানুষ আকৃতির প্রাণির জন্ম। তবে আধুনিক মানুষের মতো প্রাণির সন্ধান মেলে প্রায় ৭০ লক্ষ বছর আগে। তারা প্রাইমেট জাতীয় প্রাণিদের মতো গাছে বসবাস করতো। জীবের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে অস্ট্রালোপথেকাস জাতীয় এক ধরণের প্রাণি আফ্রিকায় বাস করতো। তারাও দেখতে মানুষের মতো ছিলো। ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ায় লুসি নামে এক অস্ট্রালোপিথেকাস জাতীয় প্রাণির জীবাশ্ম পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এই জীবাশ্ম ৩০ লক্ষ বছরের পুরনো। অস্ট্রালোপিথেকাস জাতীয় প্রাণির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তারা মানুষের মতো দুই পায়ে হাটতে পারতো। প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে হোমো হাবিলিস জাতীয় এক ধরণের প্রাণির সন্ধান মেলে আফ্রিকায়, তারাও দেখতে মানুষের মতো ছিলো। তবে আরও প্রায় ১০ লক্ষ বছর পর হোমো ইরেক্টাস নামের আরেক প্রজাতির প্রাণির আবির্ভাব ঘটে। তাদেরও সন্ধান মেলে আফ্রিকায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা তারাই প্রথম আফ্রিকা থেকে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
হোমো ইরেক্টাস জাতীয় প্রাণিরা শিকার করতো এবং আশ্রয়ের জন্য ঘর বানাতো। তারা আগুনের ব্যবহার জানতো বলেও আবিস্কার করেছে বিজ্ঞান। এই প্রজাতি থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটে। বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের মতে হোমো স্যাপিয়েন্সের দুটি উপ প্রজাতি ছিলো। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় বাস করতো একটি উপ প্রজাতি যার নাম নিয়ানডার্থাল মানব। অপরটি হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স যারা বর্তমান মানব প্রজাতি। তাদের আবির্ভাব হয়েছিলো প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে। ২০ বছর আগে নিয়ানডার্থাল প্রজাতির মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো তারা মৃতদের সমাধিস্থ করতো। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তারা হাত ও পায়ের কাজ সমানতালে করতে পারে। তবে দুই প্রজাতির মানুষই ছিলো বুদ্ধিদীপ্ত। সেখান থেকেই শুরু মানব সভ্যতার প্রাচীন যুগ। বই পুস্তকে আমরা এই প্রাচীন যুগ থেকেই জ্ঞান অর্জন করে থাকি।
ভালো লেখা। তবে মানুষের ইতিহাস বর্ণনা করতে গেলে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিসদের কথা আসা দরকার ছিল। কারন এরাই হোমো গনের সেপিয়েন্স প্রজাতির সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল। যাদের নিয়ান্ডারথাল মানুষ বলা হয়। অনেক বিজ্ঞানিদের ধারনা (বৈজ্ঞানিক ধারনা সাধারণ ধারনার মতো নয়) আজকের হোমো সেপিয়েন্সদের সাথে নিয়ান্ডারথালদের যৌন সংযোগের মাধ্যমে জিনের মিশ্রন ঘটে থাকবে। এ ধরনের ধারনার কারন হলো সম্রতি গবেষণায় মানুষের জিনে হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিসদের জিনোমের অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
যাই হোক সে এক দীর্ঘ্য আলোচনা। সুন্দর লেখার জন্য সাধুবাদ রইলো।
ধন্যবাদ,
বিশ্লেষণ করার মতো প্রত্যেকটি বিষয় আলাদা আলাদা লেখায় আসবে। তখন সেগুলো লিংক করে দেয়া হবে।