বায়তুল হিকমাহ্, বিশ্ব সেরা পাঠাগারের গল্প

বায়তুল হিকমাহ্। এক সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি ছিলো এটি। আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বায়তুল হিকমাহ্ ছিলো বাগদাদের একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অর্থনৈতিক উৎকর্ষের কেন্দ্রস্থল। জ্ঞানের চর্চা ও অর্থনৈতিক বিকাশে বায়তুল হিকমাহ্ ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই লাইব্রেরিকে তখন বলা হতো হাউজ অব উইজডম। পঞ্চম থেকে প্রায় নবম শতক পর্যন্ত সংগ্রহের দিক থেকে এই লাইব্রেরি ছিলো বিশ্বে সবচেয়ে বড়। বায়তুল হিকমাহ্ প্রায় সারাক্ষণ সমকালীন পন্ডিতদের পদচারণায় ‍মুখর থাকতো।

বায়তুল হিকমাহ্ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

বায়তুল হিকমাহ্ প্রতিষ্ঠিত হয় বাগদাদ প্রতিষ্ঠার সময়েই। দামেস্ককেন্দ্রিক উমাইয়াদের প্রভাব থেকে ইরাক ও বাগদাদকে মুক্ত করতে দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর এখানেই তার রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। সেসময় ইরাক ও ইরানে সাসানিদরা ছিলো সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী।

সাসানিদরা হলো তৎকালীন সময়ে ইরাক ও ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দুটি সাম্রাজ্যের একটির নাগারিক। সাসানীয় সাম্রাজ্য পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে প্রায় ৪০০ বছর শাসন করে। তারা এই অঞ্চলে ইসলামি শাসন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।

দীর্ঘদিন তারা এই অঞ্চল শাসন করায় আব্বাসীয় শাসন ব্যবস্থার অনেকাংশে সাসানিদদের প্রভাব ছিলো। অভিজাত সাসানিদরা প্রচুর বই জমা করতো। তাই খলিফা আল-মনসুর তাদের মতো কিছু একটা করতেই প্রতিষ্ঠা করেন বায়তুল হিকমাহ্। 

খলিফা আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি থেকেও তিনি অনেকটা অনুপ্রাণিত হয়। ৭৭৫ সালে খলিফা আল-মনসুর মারা গেলে তার এ মহৎ স্বপ্নটি অপূরণীয়ই থেকে যায়। পরে তার স্বপ্ন পূরণ করেন খলিফা হারুন আল-রশিদ।

৭৮৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি রাজদরবারের একাংশ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। বর্ধিত কলেবরে বায়তুল হিকমাহ্ নির্মাণের দায়িত্ব দেন উজির ইয়াহইয়া আল-বারমাকির ওপর।

বায়তুল হিকমাহ্’র বিকাশ

খলিফা হারুন-আল রশিদ প্রথম দিকে তার দাদা, বাবার সংগ্রহে থাকা অনেকগুলো বই নিয়ে শুরু করেন সংগ্রহশালা। রাজকীয় ব্যয়ে পারস্যের বিভিন্ন উপকথা, সাসানিয়ান জ্যোতির্বিদদের বিভিন্ন লেখা আরবিতে অনুবাদ করিয়ে বই তৈরি করেন। লাইব্রেরির এসব কাজের জন্য নিয়োগ দেন অনুবাদক ও বাঁধাইকারকদের। তবে তিনিও বায়তুল হিকমাহ্’র কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।

তার পরবর্তী সময়ে ৮১৩-৮৩৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেন খলিফা হারুন-আল রশিদের পুত্র খলিফা আল-মামুন। তিনিই বায়তুল হিকমাহ্’র চূড়ান্ত উন্নয়ন কাজ করেন। তার শাসনের আগে পর্যন্ত এই লাইব্রেরি নাম ছিলো খিজানাত আল-হিকমাহ্।

সংগ্রহ আরও সমৃদ্ধ করতে সিসিলির রাজ দরবারের পুরো লাইব্রেরিই কিনে নেন তিনি। এতসব বই সংগ্রহ করতে প্রায় ৪০০ উট ব্যবহার করতে হয় সেসময়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান

জ্ঞানের প্রসারে বায়তুল হিকমাহ্’র অবদান অনেক। এই লাইব্রেরির সাথে জড়িত অনেক দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও অনুবাদক। বীজগণিতের জনক মুসা আল-খাওয়ারিজমির প্রচুর বই সংরক্ষিত ছিলো হিকমাহতে। ৮২০ সালে তিনিই লাইব্রেরির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এছাড়াও সমকালীন সকল লেখক, কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের বইয়ের অনুবাদ সংগ্রহ করা হতো বায়তুল হিকমাহতে। পিথাগোরাস, প্লাটো, অ্যারিস্টোটল, হিপোক্র্যাটস, গ্যালেন, সক্রেটিস, ইউক্লিড কেউই বাদ যাননি তালিকা থেকে।

অনুবাদকদের প্রণোদনার জন্য খলিফা আল-মামুনের ছিলো দারুণ কৌশল। প্রত্যেক অনুবাদককে তার অনূদিত বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দিতেন তিনি। এই লাইব্রেরিটি শুধু যে সংগ্রহশালাই ছিলো না নয়। এখানে বসে জ্ঞানের চর্চাও করতেন পণ্ডিতরা।

খলিফা আল-মামুনের মৃত্যুর পর থেকেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায় বায়তুল হিকমাহ্। পরবর্তী খলিফা আল-মুতাসিম রাজধানী সরিয়ে সামারায় স্থানান্তর করেন। তার শাসনামলে লাইব্রেরিটি টিকে থাকলেও কোন উন্নয়ন করা হয়নি।

১২৫৮ সাল থেকে পুরোপুরি ধ্বংস হয় বায়তুল হিকমাহ্। দুর্ধর্ মোঙ্গল বাহিনীর তাণ্ডবে তছনছ হয়ে পড়ে বাগদাদ। পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেয় বাগদাদ। এরই সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বায়তুল হিকমাহ্।

বাইতুল হিকমাহ চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ত্রয়োদশ শতকে। ১২৫৮ সালে ঝড়ের মতো ইরাকে ঢুকে পড়ে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী, বাগদাদ তছনছ করে দেয় তারা। নির্বিচার নরহত্যায় লাল হয়ে যায় টাইগ্রিসের পানি।

এককালের জৌলুষময় বাগদাদকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় মোঙ্গলরা। এর সাথে সাথেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বাইতুল হিকমাহ। জ্যোতির্বিদ আল-তুসি অবশ্য কিছু বই রক্ষা করতে সক্ষম হন। পরিস্থিতি বুঝে আগেই সেগুলো তিনি সরিয়ে ফেলেছিলেন ইরানের মারাঘেহ মানমন্দিরের লাইব্রেরিতে।

বায়তুল হিকমাহ্ ধ্বংস হয়ে গেলেও এর প্রভাব সমাজে, রাষ্ট্রে এবং মানুষের মনে ছিলো প্রখরভাবে। একসময় অনেক ধনবানরা নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাগার। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রও হিকমাহ্’র আদলে তৈরি করে লাইব্রেরি। এমনকি অনেকে জ্ঞান চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতাও করে।

ইসলামিক বিশ্বের নামজাদা বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করতে তৈরি করা হয় বিশাল বিশাল লাইব্রেরি। কর্ডোবাতে দশম শতকে দ্বিতীয় আল-হাকাম তেমনই একটি লাইব্রেরি স্থাপন করেন। এই পথ ধরে দ্বাদশ শতকে আন্দালুসিয়ার টলেডো পরিণত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম পীঠস্থানে।

১০০৫ সালে মিশরের কায়রোতে ফাতিমীয় খলিফা আল-হাকিম প্রতিষ্ঠা করেন দারুল হিকমাহ। এই লাইব্রেরিটি বায়তুল হিকমাহ’র মতো সুনাম কুড়িয়েছিলো মুসলিম বিশ্বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *